সাক্ষাৎকার
নারী লেখকদের কৌশলী হতে হবে
-দিলারা মেসবাহ
দিলারা মেসবাহ একজন প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক। লিখছেন চার দশকের বেশি সময় ধরে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা, কিশোরসাহিত্যসহ সাহিত্যের সব শাখাতেই তার দৃঢ় পদচারণা। কেবল সাহিত্য রচনা নয়, সংগঠক হিসাবেও খ্যাতিমান এই লেখক। দীর্ঘ ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য সংগঠন নারী লেখক সংঘের, সাধারণ সম্পাদক ও প্রেসিডেন্ট হিসাবে।
দিলারা মেসবাহর জন্ম ২৮ আগস্ট, ১৯৫০ সালে পাবনার বিখ্যাত লোহানী পরিবারে। পিতা তাসাদ্দুক হোসেন লোহানী শিক্ষাবিদ ও খ্যাতিমান সাহিত্যিক। মা বেগম বদরুন নেসা লোহানী। বাবার বদলি চাকুরির সুবাদে বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাকে লেখাপড়া করতে হয়।এর মধ্য দিয়ে সমাজের মানুষ ও প্রকৃতি সম্পর্কে জানাশোনার সুযোগ ঘটে তার ছাত্র জীবন থেকে। স্বামীর কর্মসূত্রে দেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থানগত কারণেও তার অভিজ্ঞতার পরিস্ফুটন ঘটে নানা ভাবে। আর অনিবার্যভাবে তাতার লেখার জগৎকে করে প্রসারিত। তাই কখনো ঢাকা বেতারের টকার, স্ক্রিপ্ট রাইটার, সদালাপী ছদ্মনামে রম্যরচনা, সাপ্তাহিক রোববারে দীর্ঘদিন ‘প্রিয়দর্শিনী’ নামে কলাম লিখেন তিনি । ১৯৬৫ সালে ‘সবুজপাতা’য় কবিতা প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তার লেখালেখি শুরু। বর্তমানে ছোটগল্প, নিবন্ধ, শিশুতোষ রচনায় তিনি নিরন্তরভাবে মগ্ন।
গত ২৫ মার্চ লেখক ও সম্পাদক মাহমুদা আকতার এই সুসাহিত্যিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার ধানমন্ডির বাস ভবনে। এই সাক্ষাতে লেখক তাঁর লেখালেখি ছাড়াও সমসাময়িক নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। মতামত দিয়েছেন নিজের অগ্রজ এবং এসময়ের সাহিত্যিকদের লেখালেখি নিয়েও। দিলারা মেসবাহ’র সঙ্গে আলাপচারিতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ কথাসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
– এখন কি লিখছেন?
দিলারা মেসবাহ- কিছু অসমাপ্ত গল্প শেষ করার চেষ্টা করছি। এছাড়া একটা আত্মজীবনী লেখারও পরিকল্পনা আছে। এক সময় ভাবতাম আমি এমনকি করেছি যে এসব লিখে রেখে যেতে হেবে। কিন্তু এখন মনে হয়, যা দেখেছি বা দেখছি সেসব লিপিবদ্ধ করে রেখে যাওয়া উচিত। এতে যদি আগামী প্রজন্ম কিছুটা হলেও উপকৃত হয়। একজন মানুষের জীবনতো কেবল তার ব্যক্তিগত বিষয়াশয় নয়, এতে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থার অনেক বিষয় থাকে।
এখন মাঝে মাঝে আফসোস হয়। মনে হয়-আগে যদি লেখালেখিতে আরও বেশি সময় সময় দিতাম তাহলে হয়তো আরও অনেক করা সম্ভব ছিলো। একই সঙ্গে এটাও মনে হয় যে, আমার সময় বোধহয় এখনই, যদিও বয়স হয়ে গেছে। অনেকে বলতে পারেন এই বয়সে এসে এত লেখালেখির কি আছে! কিন্তু আমি মনে করি মন যতদিন তরুণ থাকে মানুষও ততদিন তরুণ থাকে। সুতরাং আমি মনে করি আমার ভিতরে যদি সেই সাহস, উদ্যোগ, স্বপ্ন, থাকে তাহলে আমি বৃদ্ধ হবোনা কখনও। কখনও বৃদ্ধ হবোনা এই অর্থে যে, আমার মন তরুণ, শরীর বৃদ্ধ হলেও আমার মন তরতাজা।
দু’মাস আগে স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ায় লেখালেখির কাজে একটু ব্যাঘাত ঘটছে। এর আগে যখনই সময় পেয়েছি তখনই লিখতে বসেছি।
– আপনি কীভাবে লিখেন, হাতে না সরাসরি কম্পিউটারে?
দিলারা মেসবাহ- আগে খাতা-কলমে লিখে পরে সেটা কম্পোজ করি। আমি কিন্তু এমনিতেও কম লিখি। অর্ডারি লেখা লিখতে পারি না। পত্রিকাওয়ালাদের তাড়ায় কখনও লিখতে বসি না। আমি নিজের পছন্দ মতো স্বাধীনভাবে লিখি। এটা আমার স্বভাব-দোষ বা গুণ যা-ই বলো, আমি এমনই।
আর একারণে আমার লেখার সংখ্যা একটু কম। আমি যখন লিখতে বসি তার আগে অনেকদিন ধরে মনের মধ্যে সেটা নিয়ে জাবর কাটতে হয়। মাথার মধ্যে তাকে লালন করতে হয়। অনেকক্ষণ তার শব্দ ও ভাষা নিয়ে ভাবি, কীভাবে শুরু করবো, শেষটাই বা কি হবে-এসবও ভাবনায় থাকে। এটা নিয়ে কি নতুন কোনও নিরীক্ষার দিকে যাব, নাকি সনাতন ধারায় লিখে যাব- নাকি দুইয়ের মিশ্রণ থাকবে. যাদুবাস্তবতা থাকবে কি না-এসব নানা বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের গল্পওহতে পারে। যাই লিখি না কেন এটা সব সময় মাথায় থাকে লেখাটা যেন পাঠযোগ্য, খানিকটা মানসম্মত হয়। এব্যাপারে কতটা সার্থক হয়েছি সেটাতো পাঠক বিবেচনা করবে। কিন্তু আমার এই চেষ্টাটা সব ধরনের লেখার ক্ষেত্রেই থাকে।
– আপা, আপনার লেখালেখি শুরুটা কীভাবে হলো, যদি আমাদের বলতেন…
দিলারা মেসবাহ- আমার বাবা ছিলেন লেখক। আমি যখন খুব ছোট তখন তাঁর বই ‘রূপকথার মায়াপুরী’ বইটি বের হয়। সেই বইটা সেই সময় খুবই জনপ্রিয় ছিলো, গোটা বাংলাদেশ জুড়ে। বিদেশের সব বিখ্যাত রূপকথার বইয়ের সাবলীল অনুবাদ করেছিলেন আমার বাবা। তার সেই সব অনুবাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলো‘রূপকথার মায়াপুরী’। এই বইয়ের ছবিগুলো এঁকে ছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী আবুল কাসেম। তো সেইটা দেখে আমার সব সময় মনে হতো আমার বাবার যদি এরকম একটা বই থাকে তাহলে তো উনার আর কিছুর দরকার নাই। ভাবতাম- আমার নিজের এরকম একটা বই কবে হবে? এটা ছিলো আমার একটা অদ্ভুত খেয়াল। সত্যি কথা বলতে কি বাবাকে হিংসা করতাম। ভাবতাম-আহারে বাবার একটা কত সুন্দর বই আছে, কী চকচকে রং! আমার এরকম একটা বই যদি থাকতো। যদিও আমার বাবা কখনও আমাকে লেখার জগতে আসার জন্য কিছু বলতেন না। তিনি শুধু বলতেন, দেখো, লেখালেখি কোনও বিলাসিতা নয়, এপথে আসতে হলে তোমাকে অনেক আরাধনা আর সাধনা করতে হবে। তাছাড়া তিনি ছিলেন একটু রক্ষণশীল।
– তবে কি বাবার তাগিদেই লেখালেখির জগতে আগমন?
দিলারা মেসবাহ- না, বাবা সেভাবে কখনই লেখালেখিতে আসতে উৎসাহিত করেননি। যদিও বাবার লেখালেখি দেখেই এই জগতে আসার প্রেরণা পেয়েছি। তবে বাবার চেয়ে তার মা-ই আমাকে বেশি উৎসাহ দিয়েছেন। সত্যিকার অর্থে মা ছাড়া আমি পরিবারের আর কারো কাছ থেকে তেমন উৎসাহ পাইনি। আরও স্পষ্ট করে বললে আমি লেখালেখিতে কোনও বটবৃক্ষের ছায়া পাইনি। লেখক জীবনের যতটুকু অর্জন সেটুকু কেবলই নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমের ফসল।
– আপনার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় কবে?
দিলারা মেসবাহ- ক্লাস নাইনে পড়ার সময় স্কুল ম্যাগাজিনে আমার প্রথম লেখা বের হয়। ছোটবেলায় আমি তেমন লিখতাম না, খুব ছবি আঁকতাম।
– আপনার প্রথম বই বেরিয়েছে কোন সালে?
দিলারা মেসবাহ- আমার প্রথম বই বেরিয়েছে ১৯৮৬ সালে-একসঙ্গে দুটি, কবিতার বই ‘কষ্টের কাঠঠোঁকরা’ আর ‘ইষ্টিকুটুমমিষ্টিকুটুম’ নামের একটি ছড়ার বই।
– আপনি শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে তারপরর কথাসাহিত্যে কীভাবে এলেন?
দিলারা মেসবাহ- আসলে গল্প বিশেষকরে উপন্যাসের ক্যানভাস খুব বড়-এখানে অনেক কিছু বলা যায় এবং মনের মতো কাজ করা যায়। কবিতায় সেসব হয় না। তাই কথাসাহিত্য শুরু করলাম।
– এ পর্যন্ত কতগুলো বই বেরে হয়েছে আপনার?
দিলারা মেসবাহ- গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, গবেষণাগ্রন্থ সব মিলিয়ে ৪৩টা। আমি ছোটদের জন্যও অনেক লিখেছি। এজন্য অনেকে আমাকে শিশুসাহিত্যিক হিসাবেও আখ্যায়িত করে থাকেন। যদিও আমি কোনও বিশেষণে বিষেষায়িত হতে চাইনা। আমি সাহিত্যের সব শাখাতেই কাজ করেছি এবং এখনও করে যাচ্ছি।
– এগুলোর মধ্যে আপনার প্রিয় বই কোনগুলি?
দিলারা মেসবাহ -‘রন্ধনবন্ধননন্দনতত্ত্ব’ নামে একটা প্রবন্ধের বই আছে আমার। আসলে প্রবন্ধ নয় খানিকটা হালকা ঢংঙে লেখা এই বইটা আমার কেন জানি ভালো লাগে। এতে আমি যেন বা বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করতে পেরেছি, একটু হলেও। চর্যাপদ থেকে শুরু করে মোগল যুগ, ঠাকুরবাড়ি এমনকি আমাদের সাহিত্যিক আবদুর রাজ্জাক ও আহমদ ছফার মতো সাহিত্যিকদের কথাও আছে এতে। একই সঙ্গে উঠে এসেছে আমাদের গ্রাম অঞ্চলের রান্নবান্নার কথাও।
– সাহিত্যের নানা শাখায় কাজ করলেও গল্পকার হিসাবে আপনি বিশেষ খ্যাত। আপনি এসব গল্পে কাদের নিয়ে কাজ করেছেন। আরও স্পষ্ট করে বললে গল্প বলার ক্ষেত্রে আপনার প্রিয় বিষয় কোনগুলো?
দিলারা মেসবাহ- আমি নিজের গল্প বা উপন্যাসে সবসময় প্রান্তিক মানুষের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করি। আমি কখনও উচ্চবিত্তদের নিয়ে লিখিনি, কেননা তাদের জীবনযাত্রা আমার কাছে মেকি মনে হয়। অন্যদিকে মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রায় কোনও বৈচিত্র্য খুঁজে পাই না। একই ভাবধারা, আদর্শ আর প্যানপ্যানানি আমার পছন্দ না। এজন্য আমি সবসময় প্রান্তিক মানুষদের কথা তুলে ধরতে পছন্দ করি। এইসবমানুষেরজীবনসংগ্রাম, ওদেরসত্য-মিথ্যা, ভণ্ডামি, বদমাইশি, ভালোমানুষী, মানবিকতা এইসব কিছুর মধ্যে সত্যিকারের জীবন খুঁজে পাওয়া যায়। এজন্য ওদের জীবনযাত্রা আমার গল্পের প্রধান বিষয়।
– কিন্তু আপনি তো প্রান্তিক মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করেন না। মানে আপনি নিজেও উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজের মানুষ-কিন্তু প্রান্তিক মানুষদের কাছে কী ভাবে পৌঁছালেন- এদের নিয়ে আপনার লেখাগুলোর সবই কি আপনার কল্পনা নাকি বাস্তব?
দিলারা মেসবাহ—মাহমুদা তুমি ঠিকই বলেছো আমি প্রান্তিক সমাজের অংশ নই। কিন্তু আমি ওদের সঙ্গে মেশার সুযোগ তৈরি করে নিয়েছি। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে আমাকে বিভিন্ন অঞ্চলে থাকতে হয়েছে। আমি সেসময় বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজনের জীবনযাত্রা ঘনিষ্ঠভাবে লক্ষ্য করেছি। এছাড়া আমার বাড়ির বাবুর্চি, সুইপার, মালি বিভিন্ন হ্যাল্পিংহ্যান্ডদের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলেছি-যারা আমার কাছে তাদের জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা নির্ধিদ্বায় তুলে ধরেছি। আমার একটা গল্প ‘খুরপিকাহিনী’ যা অনেকের পছন্দ। গ্রামীণ পটভূমিকায় লেখা গল্পটি সত্য ঘটনার ওপর লেখা। একজন কৃষক যখন তার অবস্থা ফেরার পরও জমিতে নিড়ানি দেয়ার কাজ থেকে অব্যাহতি নিতে চায় না। সারাক্ষণ খুরপি নিয়ে জমিতে পড়ে থাকতে চায়।
– অনেক প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা নিয়ে কোনও লেখা লিখেছেন কি?
দিলারা মেসবাহ- অবশ্যই লিখেছি। পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি ছাড়া তো আর লেখা হয়না। একটা গল্প অনেকদিন ধরে মাথায় ঘুরতে থাকে তারপরই না সেটা কাগজে ওঠে আসে। যেমন একটা গল্প সাতআট মাস ধরে ফেলে রেখেছি এটার উপসংহার টানতে পারছিনা। শেষটা কী রকম হলে ভালো হয় তা নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে না পারায় এটা এতদিন ধরে পড়ে আছে।
– কি গল্প এটা?
দিলারা মেসবাহ- এর নাম ‘আলী দোকানের ধলাবিবি’…
– আপা, আপনার গল্পের নামগুলো খুব অদ্ভুত। মানে অন্যরকম এবং অবশ্যই এট্রাকটিভ। যেমন ‘একজোড়া পয়পন্ত ইলিশ’ কিংবা ‘চামেলি ভিলার পরম্পরা’ এরকম আরও অনেক গল্প আছে-
দিলারা মেসবাহ—তুমি ঠিকই বলেছো। গল্পের নামটা এট্রাকটিভ না হলে পড়তে ভালো লাগে না। তাই সবসময় গল্পের নামটা একটু আনকমন দেয়ার চেষ্টা করি।
– আপনি তো রম্যরচনাও লিখেছেন অনেক-
দিলারা মেসবাহ- প্রয়াত কেজি মোস্তফা ‘সচিত্রবাংলাদেশ’ পত্রিকায় থাকতে সেখানে আমার ‘খোপাওচোপা’ শিরোনামে একটা লেখা প্রকাশিত হয়। এটা পড়ে তিনি এতটাই মুগ্ধ হন যে আমাকে মাসে দুইটা রম্য লেখার কথা বলেন। আমি দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে সচিত্র বাংলাদেশে রম্য রচনা লিখেছি। পরে এসব রম্য রচনার সঙ্কলন করেছি ‘খোপাওচোপা’ শিরোনামে।এছাড়া রোববার পত্রিকায় নিবন্ধ লিখেছি ৫বছর ধরে।
– ছোটবেলা থেকেই আপনার পড়ার অভ্যাস শুনেছি-এখনও কি পড়েন?
দিলারা মেসবাহ- হ্যা, প্রতিদিনই পড়ি-অল্প করে হলেও পড়ি। এটা আমার শৈশবের অভ্যাস। আমার বাবা এই অভ্যাস তৈরি করে দিয়েছেন। লেখালেখিতে উৎসাহ না দিলেও তিনি পড়ার জন্য বলতেন খুব। মেট্রিক ও আইএ পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বিভিন্ন ক্ল্যাসিক বই কিনে আনতেন। আমরা সেগুলো গোগ্রাসে গিলতাম। রবীন্দ্র, নজরুল, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র এইসব ক্ল্যাসিক বইগুলো তো আমরা কিশোর বেলাতেই পড়ে নিয়েছি।
– এখনকি পড়ছেন?
দিলারা মেসবাহ- বঙ্গবন্ধুর ওপর নানা রকম বই পড়ছি। ভবিষ্যতে এই মহান নেতার ওপর কাজ করার ইচ্ছা আছে। এছাড়া খনাকে নিয়েও একটা বই লিখতে চাই। তার ওপরও পড়াশোনা করছি এখন।
– আপনার প্রিয় কবি ও লেখক সম্পর্কে যদি বলতেন-
দিলারা মেসবাহ- আমার প্রিয় লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক ও রিজিয়া রহমান। আমার প্রিয় কবি আল মাহমুদ। তবে তাঁর কবিতা আর গদ্য দুটোই আমার পছন্দ। তাঁর লেখা ‘গন্ধবণিক’ তো একটা অসাধারণ গল্প।
– আপনি তো একটা আলোকিত পরিবারের সদস্য। লেখালেখিতে আপনার পারিবারিক ঐতিহ্য কতটা আপনাকে কতটা প্রভাবিত করেছে?
দিলারা মেসবাহ- হ্যা আমার চাচাতো ভাই ফতেহ লোহানী বিখ্যাত অভিনয় শিল্পী এবং সাহিত্যিক। তিনি আর্নেস্ট হ্যামিংওয়ের ‘ওল্ডম্যান এন্ড দ্য সি’ বইটির নান্দনিক অনুবাদ করেছেন। আরেক কাজিন বিখ্যাত টিভি ম্যাগাজিন ‘যদি কিছু মনে না করেন’র উপস্থাপক ফজলে লোহানিও কিন্তু ভালো লিখতেন। চাচাতো ভাই কামাল লোহানী ও লেখার জগতে আছেন। আমি তাদের সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠেছি। আমার মনে আছে বিখ্যাত ‘আছিয়া’ চলচ্চিত্রটি যখন তৈরি হয় তখন চাচা ফতেহ লোহানী বাড়িতে এনিয়ে কথাবার্তা বলতেন। তখন অনেকে এসে বাবাকে বলতেন‘আপনার মেয়েদের কি সিনেমায় নামাবেন ।’ এসব কথা শুনে আমার বাবা খুবই বিরক্ত হতেন।
আমার চাচাতো বোন হুসনা খানম গান গাইতেন, তার রেকর্ড আছে। তিনি ছিলেন মুসলিম নারীদের মধ্যে তৃতীয় সঙ্গীত শিল্পী যার রেকর্ড বেরিয়েছিলো। তিনি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন, পাশপাশি চলচ্চিত্র বিষয়ক সাংবাদিকতাও করতেন। বেগম ও অন্যান্য পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতো। একই সঙ্গে জাপানি ফুলের তোড়া তৈরি অর্থাৎ ইকোবানা শিক্ষক ছিলেন। নিজের ইকোবানা ক্লাসে আমাকেও ডাকতেন। কিন্তু সংসার সামলে আমি তো যেতে পারতাম না। আমার কেবল মনে হতো অন্যকোনও কাজে ব্যস্ত হলে সংসারের যদি কোনও ক্ষতি হয়। আমি তো লেখাপড়াও করেছি সংসার আর বাচ্চাদের সামলে।
– এসময়ের নারীরা কীভাবে আরও এগিয়ে আসতে পারে?
দিলারা মেসবাহ- এখনতো আর আগের মতো প্রতিবন্ধকতা নাই, অনেক বদলেছে সামাজিক পরিস্থিতি, তাই নারীদের নিজেদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। যদিও পুরুষতান্ত্রিক সমাজতো একটা ব্যাধির মতো। যেখানে সেখানে পুরুষ বসে আছে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে, তারা তো নারীদের লেখা একপাশে ফেলেই রাখবে, এই প্রবণতা তো এখনও আছে। পুরস্কার দেয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এবছর তো বাংলা একাডেমি পুরস্কারে কোনও নারীলেখক নেই। এমন তো না যে বাংলা একাডেমির পুরস্কার পেতে পারেন এমন নারী লেখক এদেশে বর্তমান নেই। বরং এখনকার নারীরা তো অনেক ভালো লিখছেন।
– নারী লেখকদের জন্য আপনার কোনও পরামর্শ আছেকি?
দিলারা মেসবাহ- নারী লেখকদের প্রচুর পড়তে হবে। আমারা পড়াশোনা খুব কম করি। কিন্তু পড়াশোনা বেশি না করলে তো নতুন নতুন লেখার আইডিয়া বেশি আসবে না। অনেক নারী লেখকের আড্ডা দিতে না পারার যে আক্ষেপ আছে-পড়ালেখার মাধ্যমে সেটাও মোচন করা সম্ভব। তবে লেখালেখির জন্য কিন্তু আড্ডাও জরুরি। তবে এটাও খেয়াল রাখতে হবে আড্ডা দিতে গিয়ে এগিয়ে যাওয়ার বদলে আমরা যেন আবার পিছিয়ে না পরি। এজন্য ব্যক্তিত্বকে প্রখর করতে হবে। প্রখর ব্যাক্তিত্ব ছাড়া কোনও নারী এগিয়ে আসতে পারবেন না। একটু দুর্মুখও হতে হবে। আমি মনে করি মধু, বিষ, তেতো, মিঠা- এইসব মিলিয়ে নারীকে কৌশলী হতে হবে। নারী এত কৌশল করে একটা সংসার চালায়, বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করে আর তারা মেলামেশার ক্ষেত্রে , নিজের স্থান করে নেয়ার ক্ষেত্রে কৌশলী হতে পারবে না- এটাতো হতে পারে না। সামনে অনেক সুযোগ, নারীদের নিজেদের যোগ্যতায় এগিয়ে এসে সেইসব সুযোগ গ্রহণ করতে হবে।
– আপনার পাঠকদের জন্য কি কিছু বলতে চান?
দিলারা মেসবাহ- আমি পাঠকসহ সবাইকে বলতে চাই লেখকদের লেখা পড়ুন। আপনার যে লেখককেই ভালোলাগে তার লেখাই পড়ুন, বেশিবেশি পড়ুন। কারণ অনেকখানি লেখা না পড়লে একজন লেখককে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। আর পড়ার ওপর আর কিছু হতে পারে না।
– আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
দিলারা মেসবাহ- ধন্যবাদ তোমাকেও, ভালো থাকো সব সময়।
দিলারা মেসহবাহ’র প্রকাশিত বই :
গল্পগ্রন্থ- এক জোড়া পয়মন্ত ইলিশ, চামেলি ভিলার পরম্পরা, পলাতকা ছায়াগুলো, অন্ধকার ও অপরূপ ডানা;
উপন্যাস : স্বপ্নলোকের চাবি ও নাগরদোলার দিন;
কাব্যগ্রন্থ : কষ্টের কাঠঠোকরা, শুকনো পাতা মানিব্যাগে প্রবন্ধ : রন্ধন বন্ধন নন্দন তত্ত্ব, ঠাকুরবাড়ির সমুজ্জ্বল নারীরা ও বিবিধ; শিশুসাহিত্য : ওপেনটি বায়স্কোপ, গাছ বাড়ির গল্প, ঝিলিমিলি নদীর ছড়া।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : মাহমুদা আকতার