নতুন বই
ইউসুফ শরীফের ‘প্রান্তিকজনের গল্প’ পাঠের অনুভাবনা
মুহম্মদ আবদুল বাতেন
বাইরের আরোপিত ভাষা দিয়ে সাহিত্যের প্রকৃত মূল্যায়ন করা যায় না। যদিও আমাদের মূল্যায়ন ও আলোচনা এখন কৃত্রিমতায় আচ্ছাদিত, এটি সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর। সাহিত্যের আলোচনার জন্যও নিজস্ব ভাষাভঙ্গির প্রয়োজন হয়। বিশেষণমূলক পাঠ্য বইয়ের আরোপিত ভাষা শিল্পকে স্থুলতায় ঢেকে দেয়। আমি নালায়েক হিসেবে তবু ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করি, আসলে যে শূন্যতার কোন তল নেই, আমরা শিল্পের নামে সেই অতল অভিজ্ঞানের দিকে ভেসে যাই।
সকালে জানালার কাছে বসে বৃষ্টি আর ঝড়োহাওয়া দেখছিলাম, আমার অনুভবের মধ্যে প্রকৃতির এই বিপুলতা ও সৌন্দর্য যে আচ্ছন্নতা তৈরি করে সেটিও মহান এক শিল্পকৃতি, যদিও ভাষায় তা রূপ দেয়া যায় না। আমি ভাষা, শিল্প, জীবন, জগত ও প্রকৃতিকে অবিচ্ছিন্নভাবে দেখি, এজন্য আমার লেখা ও চিন্তার গতি মন্থর হয়ে যায়, লিখতে চাই, কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবো, কোথায় শেষ হবে তার প্রান্ত খুঁজে পাই না।
আমি চাই অকৃত্রিম অবলোকন, চেতনাপ্রবাহের মধ্যে জীবনের অসীমতার খেলা, যা হবে প্রকৃতির মতো, অনুকরণ অযোগ্য। আমরা সেই শিল্প ও পাঠক মন থেকে বহুদূরে স্থির কাঠামো হয়ে আছি। নিজের দায়মুক্তির লেখায় আমি সায় দিতে পারি না, তাই অচেনা, নিরব পথে ছুটে চলা।
এই বৃষ্টি মগ্নতার মধ্যেই বিছানায় কয়েকটি বই ছড়িয়ে আছে, আমি পড়ছিলাম একটি গল্পগ্রন্থ, বইটির নাম ‘প্রান্তিকজনের গল্প’। লেখক কথাশিল্পী ইউসুফ শরীফ। এই লেখক সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কমবেশী ধারণা আছে। মূল ধারার এই লেখক অন্তত পাঁচ দশক ধরে লিখে যাচ্ছেন, গল্প, উপন্যাস এবং সাহিত্য ও সমাজ নিয়ে ভাবনামূলক গদ্য। তাঁর লেখার সঙ্গে এবং আমার ব্যক্তিগত পরিচয় প্রায় তিন দশক ধরে। তাঁর কথাসাহিত্যের পরিধি ব্যাপক, যা এই আলোচনাতে তুলে ধরা সম্ভব নয়। এটি কেবল ‘প্রান্তিকজনের গল্প’ পাঠের প্রতিক্রিয়া মাত্র। এই পাঠের মাধ্যমে আমি তাঁর শিল্পচেতনা, ভাষাভঙ্গি ও বিষয়গত আখ্যান অনুধাবনের চেষ্টা করেছি। বইয়ের নামের মধ্যে বইটির বিষয়গত আভাস রয়েছে। মূলত এই বইয়ের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। এই মানুষ একা নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জীবনের গভীরতর এক সংগ্রাম, সাধারণভাবে আমরা বুঝি জীবন সংগ্রাম। মানুষ ভিন্ন গ্রহের কোন প্রাণী নয়, এই মানুষের আছে জীবন-জীবিকার সংগ্রাম, আছে তার অন্তর্গত চেতনার জগত। ইউসুফ শরীফ একই সাথে জীবন যুদ্ধ এবং তার মনোজগতে ভ্রমণ করেছেন। বর্ণনার মধ্যে ভাষার পরিমিতি ও ধীশক্তি ব্যবহার করেছেন। একটার পর একটা অবিচ্ছিন্ন সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে মানুষের ভেতর জগতে প্রবেশের চেষ্টা করেছেন। এই মানুষের মধ্যে লেখক ইতিহাসের ধারাক্রম, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, জনজীবনের আন্তঃসংযোগ, ক্ষুধা, মৃত্যু, যৌনতার স্পৃহা ও অবদমনের চিরায়ত বাস্তব তুলে ধরেছেন। গভীর নিবিষ্ট, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছাড়া এই গল্পের বিন্যাস সম্ভব নয়। সমকালীন কথাসাহিত্যে ইউসুফ শরীফের এই শিল্পকৃতিকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
একটা বড় নদীর যেমন অনেক শাখা নদী থাকে, ইউসুফ শরীফের গল্পের পরিসরে এতো বিপুল আখ্যান, বিস্তৃতি, জীবন, ইতিহাস, আরো ভেতরের ছবি, বাস্তবের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা অন্তর্দাহ, প্রকৃতি মিলে একটা অখন্ড কাঠামো তৈরি করে, পাঠপর্বে যে কোন পাঠককে বিপুল অনুসঙ্গের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, প্রাজ্ঞতা দিয়ে তা অতিক্রম করতে হয়।
সবগুলো গল্পেই ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা, চিত্ররূপময় ভাষায় একটা ক্যানভাসে বহুস্তরের অবচেতনার দুয়ার খুলে দেন। একই সাথে গল্পের চরিত্র এবং স্থান ও কালকে ছবির মতো সামনে হাজির করেন। প্রান্তিক মানুষের ভেতর ও বাইরের প্রতিটি স্পন্দন ইউসুফ শরীফ তাঁর ভাষায় ত্রিমাত্রিক ছবির মতো জীবন্ত করে তুলেছেন। গদ্যের মধ্যে তিনি পোয়েটিক ইমেজ তৈরি করেন। যা একজন কথাসাহিত্যিককে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যায়। ‘নদী ও মানুষের গল্প’ শিরোনামে গল্পের মধ্যে তাঁকে আলাদভাবে চেনা যায়। বাংলা কথাসাহিত্যের ধারার ঐতিহ্য ধরে রেখে তিনি প্রাচ্য- পাশ্চাত্যের শিল্পচেতনা ও দার্শনিক ভাবনার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন।
আমি এই গল্পের বিস্তৃত অনুসঙ্গ টেনে এনে লেখা শেষ করতে পারবো না। এই একটি গল্প নিয়েও আলোচনা প্রসারিত হবে। তাঁর গল্পের কয়েকটি লাইন এখানে তুলে ধরছি।
‘নাউভাঙা আর ভোলারচর যেখানটায় মিশেছে সেখানে নিঃসঙ্গ বটগাছের সবুজ পত্র-পল্লব মরা আলোর কালশিটে হয়ে আছে আকাশের গায়ে। আকাশটা হতবুদ্ধি আর লোকটার পায়ের তলায় ছড়ে যাওয়া বালির চারপাশের রঙ ঘোলা কাঁচের মতো ঈষৎ বাদামি। জোছনার ওই আলোটুকু বিছিয়ে না থাকলে বালির কুচানো হাজারও তরঙ্গ হতো কৃষ্ণগহ্বরের উপর -কাঠামোর মতো।”
নাউভাঙা আর ভোলারচর থেকে, বালুচর থেকে আকাশ এবং গভীর মহাকাশের কৃষ্ণগহ্বর এই ভ্রমণ পথ ভাষা থেকে অবচেতনায় সঞ্চারিত করেছেন। ইউসুফ শরীফ মানুষের জীবন ও প্রকৃতির মধ্যে একটা অভিন্ন সংযোগ স্থাপন করেছেন।
কথাশিল্পী ইউসুফ শরীফের লেখায় তাঁর চিন্তা ও অভিজ্ঞতা মানব জীবনের গভীরতর ভাবনা উসকে দেয়, তাঁর চিন্তা তাৎক্ষণিকতায় নিভে যায় না, ‘প্রান্তিকজনের গল্প’ বইটি তাঁর শিল্পসত্ত্বার বিশেষত্ব ধারণ করে আছে । বইটিতে সংকলিত তাঁর ১৯টি গল্প বহুমাত্রিক অনুসঙ্গ হাজির করেছে, তিনি অতীত এবং বর্তমানকে আয়নার সামনে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন।
মৃৎপুরের হরিনারায়ণ পাল, ফিরে আসা কিংবা থেকে যাওয়া, খুন করা যায় না, স্বপ্নবাড়ির কুসুম, দুঃস্বপ্নের এই সুটকেস, গন্ধ নাকি সুবাস, এক লাইলীর প্রতিকৃতি, নগ্নতার অন্তর বিন্যাস, ওরা ভয় পায়, সেই রিনঝিন হাসি, বানভাসি, ছোবল, কিছুই পারে না, রক্তজবা বিষয়ক খসড়া, নিশিতে পাওয়া সায়লা, বুনোরাত, আচানক এইসব দৃশ্য, লাগাম ছেঁড়ার কাল- এই গল্পগুলোর মধ্যে বহুমাত্রিক আখ্যান আলো ছায়া ফেলছে। এই সব গল্পের মধ্যে প্রবেশ পাঠককে চুম্বকীয় ধূসর ক্লাউড এবং দার্শনিক আবছায়ায় টেনে নেয়। এসব গল্পের ইনসাইড বাতাবরণ ভেদ করা সত্যিকার সৃষ্টিশীল সমালোচকের কাজ।
ইউসুফ শরীফের গল্পে মুক্তিযুদ্ধ এবং আগে ও পরের স্বপ্ন ও সংকট উঠে এসেছে, তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রচলিত সরলীকৃত ধাঁচের কৃত্রিম বয়ান নেই, অনুসঙ্গ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের ভেতরকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পরিণতি একটা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে হাজির হয়েছে, মূলত তিনি জীবনের গল্প লিখছেন, আর এই জীবন, সংকট ও টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে একটা নৈব্যক্তিক ভাবলোক তৈরি করে, চিরায়ত প্রশ্ন হাজির করে, কি পেলাম, কি পাইনি সেই হিসাব মেলানো কখনোই শেষ হয় না।
বইয়ে ‘মৃৎপুরের হরিনারায়ণ পাল’ গল্পটিতে মুক্তিযুদ্ধ অনুসঙ্গ মাত্র, আসলে তিনি একজন মৃৎশিল্পীর জীবনের মধ্যে ইতিহাস ও পূর্বাপর বিবর্তনের দ্বৈত জীবন-সংকট হাজির করেছেন, যেখানে সময় একটি বড় নির্দেশক। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের জীবনবোধের পরিবর্তন, যেখানে মানুষ তার অতীতকে ত্যাগ করে বর্তমানকে গ্রহণ করে, পুরান পেশা ও জীবনধারার বিলুপ্তি ঘটে, আর বর্তমান যে আশা ও আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়, শেষাবধি সেটি সময়ের অতল গর্ভে হারিয়ে যায়। মৃৎশিল্পীর পেশা হরিনারায়ণ পালের শুধু জীবিকার বিষয় নয়, এটা তার শিল্পআত্মার অঙ্গীকার। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই পেশা পরিত্যাজ্য হলেও হরিনারায়ণের কাছে তা নয়, হরিনারায়ণ সময়ের মধ্য-রেখায় দাঁড়িয়ে বিবর্তনের একটা বিষাদময় ইতিবৃত্ত হাজির করেছেন। এটি সভ্যতা ও ইতিহাসের একটি প্যারাডক্সিক্যাল বাস্তবতা। মানুষ আশা করে, কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ পিছু ছাড়ে না, ‘হেথা নয়, হোথা নয়, অন্যকোন খানে’ জীবনের এই দার্শনিক ও স্পৃচ্যুয়াল ভাবনা থেকে আমরা কেউ মুক্ত নই। হরিনারায়ণ পাল সামগ্রিক জীবনের প্রতীক হিসেবে হাজির হয়েছেন। এই গল্পের বিস্তৃত প্রসঙ্গ হাজির করা মানে দীর্ঘতর আলোচনায় ঢুকে পরা, আপাত সেই ভার গল্পের পাঠকের ওপর ন্যাস্ত থাকলো।
এদেশে মৃৎশিল্প যে বিলুপ্তি ঘটেছে, সেটা অজানা নয়। এই গল্পে তার ঐতিহাসিক ধারাক্রম বর্ণিত হয়েছে। হরিনারায়ণ পাল সেই সাক্ষী হিসেবেও হাজির হয়েছেন। হরিনারায়ণ পাল মৃৎশিল্পের মৃত্যু ঘটিয়ে ছেলের সঙ্গে উন্নত জীবনের আশায় তার এই শিল্পালয় ছেড়ে ঢাকায় যেতে চান না, তিনি মৃৎশিল্প, মাটি ও মানুষকে একই অস্তিত্ব রূপে দেখেন। হরিনারায়ণ পালের জবানিতে এই গল্পে ইউসুফ শরীফ সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাস প্রতিস্থাপিত করেছেন। হরিনারায়ণ পাল প্রশ্ন তোলেন, ‘এই দেহ মাটির- মাটির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে এই দেহখাঁচা- তার ভেতরের এই প্রাণ- ঠিক নয় কী?’ মাটি দিয়েই মৃৎ শিল্প, আমাদের এই দেহ মাটি দিয়েই তৈরি, আবার সব কিছুই এই মাটিতে মিশে যায়।
গল্পের এই হরিনারায়ণকে আমি দেখেছি, তবে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে নয়, তিনি ঘন পত্রপল্লবে ঢাকা আমার নিজ গ্রামে। যেখানে এক সময় খালের ঘাটে কুম্ভকার নারী-পুরুষকে গোসল করে ঘরে ফিরতে দেখেছি, আর সেই শিল্পীর নামও ছিল প্রায় অনুরূপ ‘ভাসাই পাল’। ভাসাই পালকে চিনেছি যাত্রাপালায়, ছয় ফুট লম্বা কুম্ভকার ও যাত্রাশিল্পী কারবালার কাহিনী নিয়ে যাত্রাপালায় ইমাম হোসেনের অভিনয় করতেন। সেই দৃশ্য আজো স্মরণীয় হয়ে আছে। তার বাড়ির নাম ছিল ‘কুমার বাড়ি’। তাঁকে এই মৃৎশিল্প-কাজে নিবিষ্ট দেখেছি। আজ সেই ভাসাই পাল নেই, কুমার বাড়িও নেই, তবু ওই পথে চলার সময় আমার চোখ ওখানে ঘুরে যায়, কল্পনায় ভাসাই পালকে কাদা ছেনে মৃতপাত্র তৈরিতে নিবিষ্ট দেখতে পাই, হ্যাজাকের আলোর সংলাপ বলতে বলতে ভাসাই পালকে মঞ্চে উঠতে দেখি।
অতীত হারিয়ে যায় না, স্মৃতির মধ্যে সঞ্চিত হতে থাকে। কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাই ‘মৃৎপুরের হরিনারায়ণ পাল’ গল্পের লেখককে। এই গল্পে আরো অনেক গল্পের প্রতিরূপ গড়ে তোলার জন্য, যেমন আমি পেয়েছি ভাসাই পালকে, গল্পের পাঠকরাও হয়তো অনুরূপ গল্পের স্মৃতির দিশা খু্ঁজে পাবেন। গল্প গ্রন্থটির পাঠ থেকে পাঠকের মনে আরো অনেক গল্পের জন্ম হবে। তাঁর গল্প পাঠককে বিপুল অভিজ্ঞতা ও কল্পনার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নেয়। আমি এই গল্পপাঠে মুগ্ধ হয়েছি, এই অসাধারণ সৃষ্টির জন্য কথাশিল্পী ইউসুফ শরীফকে শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন জানাই।
২৯/০৭/২৩