বৈদেশিকী

‘উপন্যাস কোনো কিছুকে প্রমাণ করে না, উপন্যাস অনুসন্ধান করে এবং প্রশ্ন উত্থাপন করে’

বিশ্বখ্যাত কথাসাহিত্যিক মিলান কুণ্ডেরা

রুহুল গনি জ্যোতি

বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিইং’ এর লেখক বিশ্বখ্যাত চেক সাহিত্যিক মিলান কুণ্ডেরা ৯৪ বছর বয়সে গত ১১ জুলাই প্যারিসে মারা গেছেন। দীর্ঘ দিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুখে ভুগছিলেন।

উপন্যাস ছাড়াও কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ ও চিত্রনাট্য লিখেছেন কুণ্ডেরা। ১৯২৯ সালে জন্ম নেওয়া এই লেখককে তাঁর লেখা ও ভিন্নমতের কারণে ফ্রান্সে নির্বাসিত হতে হয়েছিল। চেক ও ফরাসি ভাষায় লিখতেন তিনি। চল্লিশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর লেখা। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে কুণ্ডেরা ফ্রান্সে বসবাস করছিলেন।

মিলান কুণ্ডেরা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘লেখক হওয়া মানে একটি সত্যকে জানা। আপনি যদি বলেন, ‘আমার সারাটা জীবন কাটল অ্যাডভেঞ্চার ছাড়া,’ তাহলে সেটাকে ব্যর্থ বই আর কী বলা যাবে, তা-ই না? এই উপন্যাসই আমাদেরকে অ্যাডভেঞ্চারের এমন কদর করতে মানসিকভাবে গড়ে দিয়েছে।’’

কুণ্ডেরার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য জোক’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। এ উপন্যাসে তিনি তৎকালীন চেকোশ্লোভাক কমিউনিস্ট শাসনের রূঢ় চিত্র তুলে ধরেন। এটি ছিল দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে নির্বাসিত ভিন্নমতাবলম্বী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠার পথে তাঁর প্রথম ধাপ।

কুণ্ডেরার রচনায় স্বৈরশাসন বা স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার বিরুদ্ধে বার বার প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। তবে সেই প্রতিবাদ কখনই উচ্চকিত ছিল না। তার সাহিত্যের মাধ্যমে কোনও ‘বার্তা’ দিতে তিনি পছন্দ করতেন না। সূক্ষতম রসবোধ, তির্যক বাচনভঙ্গি আর এক আপাত-নির্লিপ্তিই তাঁকে ‘সকলের চাইতে আলাদা’ করে রেখেছিল। তাঁর এই বিশেষ দর্শন ও ভঙ্গিমা একুশ শতকের বিশ্বসাহিত্যের একটা বড় অংশকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।

দীর্ঘ জীবনে বহুবার বিতর্কে জড়িয়েছেন কুণ্ডেরা। চেকোশ্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে চরবৃত্তির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। সরকারের রোষানলে পড়ে তিনি ফ্রান্সে পালিয়ে যান। তবে, এই সব অভিযোগকে তিনি- তাঁর রচনার মতোই শ্লেষের সঙ্গে উড়িয়ে দেন। চেকোশ্লোভাকিয়ার সরকার ১৯৭৫ সালে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালে পুনরায় নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হলেও তিনি আর স্বদেশে ফিরে যাননি।

কুণ্ডেরা বলেন, ‘রাশিয়া নয়, কমিউনিজম হচ্ছে কোনো জাতিকে তাদের সত্তা থেকে বঞ্চিত করার কুশীলব। স্টালিনিস্ট সন্ত্রাসের সময় আমি রসবোধের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলাম, তখন স্বীকৃতির বিশ্বাসযোগ্য লক্ষণ ছিল এই রসবোধটুকু। তারপর থেকে ক্ষয়িষ্ণু রসবোধের কোনো দুনিয়ার কথা ভাবতে গেলেই ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।’

কুণ্ডেরা বলেন, ‘সবকিছুর উত্তর যখন হাতের নাগালে তৈরি করা থাকে, তখন তা মানুষের মধ্যে নির্বুদ্ধিতার জন্ম  দেওয়ার কারণ হয়। আর সবকিছুকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে উপন্যাসের প্রজ্ঞালাভ ঘটে।’

কুণ্ডেরার মতে, একটা উপন্যাস কোনো কিছুকে প্রমাণ করে না, উপন্যাস অনুসন্ধান করে এবং প্রশ্ন উত্থাপন করে। তিনি বলেন, আমি জানি না আমার জাতি বিলীন হয়ে যাবে কি না, আমি এও জানি না আমার চরিত্রগুলোর মধ্যে  কোনটি সঠিক। আমি গল্প তৈরি করি, একটাকে আরেকটার সামনে দাঁড় করাই, আর এসব উপায়ে আমি প্রশ্ন করি।’

বিশ শতকের বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সেরা কথাসাহিত্যিক মিলান কুণ্ডেরা বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে উপন্যাসের গুরুত্ব অনেক বেশি, উপন্যাস ছাড়া একজন ইউরোপীয় মানুষকে ভাবাই যায় না, তাকে তৈরি করেছে এ উপন্যাসই। শতশত বছর ধরে এ মানুষেরা সবার আগে উপন্যাসটাই পড়েছে। অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি ভালোবাসার ব্যাপারটা ইউরোপীয়দের একান্ত কাছের, অ্যাডভেঞ্চারকে গুণ হিসেবে দেখা হয়।

সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তিনি অবদান রেখেছেন। তবে, তার প্রসিদ্ধি মূলত ঔপন্যাসিক হিসেবেই। কুন্দেরার জন্ম চেকো¯েøাভাকিয়ার বার্নো শহরে। তাঁর বাবা লুডভিক কুণ্ডেরা ছিলেন খ্যাতিমান পিয়ানোবাদক ও সঙ্গীতজ্ঞ। বাবার হাত ধরেই কুণ্ডেরার শিল্পের জগতে প্রবেশ। প্রাথমিক ভাবে সঙ্গীতের শিক্ষা লাভ করলেও পরে তিনি মনপ্রাণ ঢেলে দেন লেখালেখিতেই। ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন কুণ্ডেরা । তবে ১৯৫০ সালে এই পার্টি থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি তখন প্রাগে পড়াশোনা করছিলেন। স্নাতক হওয়ার পর সেই শহরেই অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালে কুণ্ডেরাকে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ ফিরিয়ে দেওয়া হলেও ১৯৭০ সালে আবার তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি ১৯৭৫ সালে দেশ থেকেও বিতাড়িত হন।

মিলান কুণ্ডেরার সাহিত্য বিচিত্র পথগামী। প্রাথমিক পর্বে তাঁর লেখালিখিতে রাজনৈতিক উচ্চারণ প্রকট থাকলেও পরে তিনি সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ইউরোপীয় নবজাগরণ পর্বের সাহিত্যের উত্তরাধিকার তিনি বহন করছেন বলে জানান। ১৯৮৪ সালে ‘দি আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হলে সাহিত্য মহলে আলোড়ন পড়ে যায়। কুণ্ডেরা পরিচিত হতে শুরু করেন ‘দার্শনিক লেখক’ হিসাবে। তাঁর পূর্ববর্তী রচনা ‘দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’ থেকেই লেখক সর্ভেন্তিস, জভান্নি বোকাচ্চিও বা রাবেলাইয়ের প্রভাব তাঁর রচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। তিনি নিজে সেকথা স্বীকারও করেন। কার্যত কুণ্ডেরার  লিখন-শেলী হয়ে দাঁড়ায় ঈষৎ বঙ্কিম চালে দেখা জীবন বা জীবনোত্তীর্ণ জগতের সন্ধান। ‘ইম্মর্টালিটি’, ‘আইডেন্টিটি’ বা ‘ইগনোরেন্স’ উপন্যাসে তিনি এই ভঙ্গিমা এবং দর্শনের আরও বিস্তার ঘটান।

জীবনে বহু পুরস্কার পেয়েছেন কুণ্ডেরা । ১৯৮৫ সালে তিনি জেরুজালেম পুরস্কার পান। ১৯৮৭ সালে প্রবন্ধগ্রন্থ ‘দি আর্ট অফ নভেল’-এর জন্য পান অস্ট্রিয়ার স্টেট প্রাইজ ফর ইউরোপিয়ান লিটারেচার। ২০২০ সালে তাঁকে ফ্রান্জ কাফকা পুরস্কার প্রদান করে তাঁর দেশ চেকোশ্লোভাকিয়া। ১৯৮৮ সালে মিলান কুণ্ডেরার  উপন্যাস ‘দি আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং’ হলিউডে চলচ্চিত্রায়িত হয়।

কুণ্ডেরার ভাষায়, ‘ছোটবেলায় হাফপ্যান্ট পরার বয়সে আমি অলৌকিক এক মলমের স্বপ্ন দেখতাম যে মলম শরীরে মাখলে অদৃশ্য হতে পারব। তারপর বয়স বাড়ল, লেখালেখি শুরু করলাম, সফল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগল। এখন আমি সফল হয়েছি, আর এখনো আমি সেই মলমটা চাই, অদৃশ্য হওয়ার মলম।’