রম্যগদ্য=
রেস্টহাউসে একরাত
আবদুল মাজেদ
রেস্টহাউসে পৌঁছেই কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞাসা করলাম এখানে সাপের উপদ্রব আছে কী-না। ৪০ ডিগ্রী তাপমাত্রার আর্দ্র আবহাওয়ায় আমরা হাঁসফাস করলেও শীতল রক্তের সরীসৃপ-সাপের কাছে তা বসন্তের সুবাতাস। এ রকম আবহাওয়ায় তাদের পক্ষে গর্ত থেকে বের হয়ে প্রমোদভ্রমণ করাই স্বাভাবিক।
সদর রাস্তা থেকে তিন কিলোমিটার ভিতরে জঙ্গলঘেরা পাহাড়ের চূড়ায় এই রেস্টহাউস। আমার মত সমতলভূমির মানুষের কাছে ছোটখাট টিলাই পাহাড়। একে তো জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়, তার উপরে জনবিরল। ৫/৬ কিলোমিটার দূরে গভীর নলকূপ বসিয়ে পাম্প করে পাইপের মাধ্যমে এখানে পানি আনা হয়। এছাড়া পানির কোন বিকল্প কিংবা প্রাকৃতিক উৎস এখানে নেই। নদী-খাল, পুকুর-ঝর্ণা, প্রস্রবণ কিছুই নেই। পর্যাপ্ত পানির উপস্থিতির সাথে জনবসতির নিবিড় সম্পর্ক। এলাকাটা জনবিরল হওয়ায় পশুপাখির সাথে সাপের অভয়ারণ্য হওয়াই স্বাভাবিক। আমার যেহেতু একটু হারপিটোফোবিয়া/অফিওফোবিয়া (সর্পভীতি) আছে, তাই কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞাসা করে আশ্বস্ত হয়ে নিলাম।
পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে কেয়ারটেকার ভালোভাবে বুঝিয়ে দিল যে রেস্টহাইসে কোনো মশা নেই। জানালা-দরজায় নেট লাগানো আছে। ঘুমানোর আগে এ্যারোসল স্প্রে করে দিবে।
আমি বললাম, এ্যারোসলে হবে না। মশারি টাঙিয়ে দিতে হবে। মশারি টাঙানোর সময় আমি সাবধানে তোষক উল্টে-পাল্টে দেখে নিলাম, তোষকের নিচে কোন বিষধর কালাচ কিংবা গোখরো ওঁৎ পেতে আছে কি না। জাজিম এবং খাটের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাও ভাল করে দেখে নিলাম। এসব নির্জন এলাকায় সচরাচর মেহমান আসে না, তাই বেশিরভাগ সময় রেস্টহাউস ফাঁকা পড়ে থাকে।
বসতবাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকলে পোকামাকড়, ভূতপ্রেত আর সাপের অপদখলে চলে যায়।দরজা জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে সতর্কতার সাথে দেখে নিলাম আড়ালে কোনো কিছু আছে কি না। তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুলির ডগা দিয়ে এমন আলতোভাবে পর্দা সরালাম যেন মাকড়সা হুল ফুটাতে না পারে। কিছুক্ষণ আগে বাথরুমে একটা মাকড়সাকে ছোটাছুটি করতে দেখলাম।
ভাববেন না যে আমার মাকড়সাভীতি বা আরাখনিফোবিয়া আছে। একবার আলনা থেকে শার্ট নেয়ার সময় হঠাৎ মনে হয়েছিল, কেউ যেন গনগনে আগুনে উত্তপ্ত সূচ আমার হাতে ফুটিয়ে দিয়েছে। মনে হলো সাপেই কামড়ছে। মুহূর্তেক পরে আলনা থেকে একটা বড়সড় মাকড়সা পালিয়ে যেতে দেখে আশ্বস্ত হলাম, এটা সর্প-দংশন
নয়, মাকড়সার হুল-ফুটানোর যন্ত্রণা। গোখরো সাপ ও মাকড়সার বিষ একই গোত্রের। নিউরোটক্সিন। সেই থেকে মাকড়সার ব্যাপারেও আমি প্রয়োজনোতিরিক্ত সাবধানী। কাঁকড়া বিছের ব্যাপারে আমার একই রকম অভিজ্ঞতা।জুতা পরতে গিয়ে পায়ে হুল ফুটিয়েছিল। দায়ে ঠেকে সাবধানতা অবলম্বন আর ফোবিয়া একজিনিস নয়। তবুও ভাগ্য ভালো যে, আমাদের দেশে ট্যারেনটুলা নামক ভয়ংকর বিষধর মাকড়সা নেই।
গ্রীক পুরাণে বলা হয়েছে যে, আরাখনি খুব ভাল কাপড় বুনতে পারত। সে লিডিয়া শহরের এক রঙ মিস্ত্রির কন্যা। এদিকে জ্ঞান, কারুশিল্প ও যুদ্ধের দেবী এ্যাথেনা ছিল তার বুনন শিল্পের শিক্ষয়িত্রী।আরাখনি একবার ছদ্মবেশী এ্যাথেনার সামনে অহংকার করে বলেছিল যে, বুনন বিদ্যায় (উইভিং) সে এতটাই পটিয়সী যে, সে চাইলে খোদ গ্রীক দেবী এ্যাথেনাকে কাপড় বোনা শেখাতে পারে। তার এই অহংকার দেখে এ্যাথেনা তাকে একটা শিক্ষা দিতে মনস্থির করে এবং আরাখনিকে বুনন প্রতিযোগিতায় আহবান করে। প্রতিযোগিতার শর্ত ছিল, যে হেরে যাবে সে আর কখনও তাঁত কিংবা মাকু স্পর্শ করতে পারবে না। গ্রীক দেবী এ্যাথেনা
প্রতিযোগিতায় জিতে যায় এবং শর্তানুযায়ী আরাখনি আর কখনও বুনন-সামগ্রী স্পর্শ করতে পারবে না।
আরাখনি কাপড় না বুনে থাকতেও পারে না, তাই এ্যাথেনা তাকে অভিশাপ দিয়ে মাকড়সায় পরিণত করে দেয়। এর ফলে প্রতিযোগিতার শর্তও ভঙ্গ হলো না আবার আরাখনি তার স্বভাব অনুযায়ী সারাজীবন মাকড়ার জাল (ওয়েব) বুনে চলতে পারবে। এভাবেই আরাখনি মাকড়সায় পরিণত হয় এবং মাকড়সাকে গ্রীক ভাষায় বলা হয় আরাখনি।
শহরের বাড়িতে প্রতিদিন নিয়ম করে ঝাড়ামোছার কাজ চলায় মাকড়সা ও কাঁকড়া বিছে কম দেখা যায়।তবে বাথরুমের দরজার চৌকাঠের পোকায় খাওয়া অংশ ও রান্নাঘরের সিংক থেকে মাঝেমাঝেই চেলা বিছে বা সেন্টিপিড বের হয়ে আসতে দেখা যায়। একটু বড় সাইজের চেলাকে বলা হয় তেঁতুলে বিছা। গয়না হিসেবে কোমরে যে বিছা পরা হতো বলে শুনেছি, তা মূলত এই তেঁতুলে বিছার আদলে গড়া। যে জিনিস দেখলেই ভয়ে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায় তার আদলে গয়না গড়িয়ে মানুষ কীভাবে কোমরে পরত আল্লাহই জানেন। কোনো কোনো মহিলাকে দেখেছি সাপের চামড়ার মত দেখতে পার্স এবং ভ্যানিটি ব্যাগ দেখলেই ভয়ে আঁৎকে ওঠে। এরাই প্রকৃত হারপিটোফোব।আবার অনেকেই স্বচ্ছন্দে এগুলো ব্যবহার করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের বাথরুমেও ছোটছোট চেলা বিছা দেখেছি। হলের বাথরুমগুলোতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা ছিল না। সন্ধ্যায় প্রাইভেট ট্যুইশনি সেরে যখন বাথরুমে গোসল করতাম তখন মনে হতো এই বুঝি চেলা-বিছাগুলো আমার পা বেয়ে উপরে উঠছে। বিষয়টা এরকম, শাওয়ারের পানি শরীর বেয়ে হাঁটুর নিচে যখন পৌঁছত তখন পায়ের লোমের ফাঁক গলে কিছুটা ইরেগুলারভাবে পা বেয়ে পানির ফোঁটা গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে নামত। তখন পায়ে একটা অদ্ভুত শিহরণ জাগত এবং মনে হতো পা বেয়ে চেলা-বিছা উপরে উঠে আসছে। পানি নামছে নিচে, অথচ মনে হতো চেলা উঠে আসছে উপরের দিকে- আমার অনুধাবন এতটাই বিপরীতমুখী আচরণ করত। ভয় পেয়ে মাঝে মাঝে বাথরুম থেকে বের হয়ে আলোতে গিয়ে দেখেছি- আসলে কিছুই না। তবুও ভয় কাটে না। এটাকে ফোবিয়া বলা যেতেই পারে।
মশারি টাঙিয়ে চলে যাওয়ার পাঁচ মিনিট পরেই কেয়ারটেকার আবার ফিরে এসে বলল, ‘স্যার, রাতে মাঝেমাঝে তক্ষক ডাকতে পারে। দুচারবার ডেকে থেমে যায়, মাঝেমাঝে ঘরে ঢুকে পড়লেও কোনো ক্ষতি করে না।’
ধোঁয়া দেখলে কেবল যে আগুনের আঁচ পাওয়া যায় তাই নয়, যে কোনো মুহূর্তে লেলিহান শিখাও দেখা যেতে পারে।কেয়ার-টেকার সেকথাই চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো।
আমি সর্প বিশারদ নই। তাই তক্ষকের বিষ আছে কী-না, কিংবা থাকলেও কামড়ায় কি-না সে বিষয়ে নিশ্চিত নই। তবে মহাভারতে পড়েছি তক্ষক রাজা পরীক্ষিতকে কীভাবে বিষে জর্জরিত করে মেরে ফেলেছিল।এমনকি রাজা পরীক্ষিতকে দংশন করতে যাওয়ার পথে একটি গাছে ছোবল দিয়ে তার বিষের তীব্রতার প্রমাণ দিয়েছিল একজন ওঝাকে। তক্ষক গাছে ছোবল দেয়ার সাথে সাথে গাছটি বিষের তীব্রতায় ছাই হয়ে গিয়েছিল।
ঘটনাচক্রে ঐ ওঝা মোটা টাকার বিনিময়ে রাজা পরীক্ষিতকে সম্ভাব্য সর্পদংশনের বিপদ থেকে বাঁচাতে যাচ্ছিলেন। তক্ষক জানতে পেরে তাকে আরো মোটা টাকা দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। কে বলে, ঘুষ কেবল কলিযুগের কেরামতি! রাত দুপুরে কেয়ারটেকার এসে জানিয়ে গেল এহেন তক্ষক ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়তে পারে, এবং তাতে নাকি ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
সবধরণের পানি সহজলভ্য না হওয়ায়, সর্বশেষ বরফ যুগের পরে এখানে সম্ভবত: জনবসতি গড়ে ওঠেনি।সর্বশেষ বরফ যুগের আগে যারা মারা গিয়েছিল তারা কেউ স্বর্গে, কেউ নরকে নিজনিজ কর্মফল অনুযায়ী সুখ অথবা শাস্তি ভোগ করছে। তাই আশেপাশে কোনো অতৃপ্ত আত্মা কিংবা কোনো অশরীরীর অস্তিত্ব আমার
ষষ্ঠেন্দ্রিয় (এক্সট্রা সেনসরি পারসেপশন-ইএসপি) দ্বারা অনুভব করতে পারলাম না। মানুষ ভয় পেলে তার ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের দরজা হুড়মুড় করে খুলে যায়। যদিও কোহ-এ-কাব শহরের জ্বিন মাত্র দু’শত ফুট উঁচু জনবিরল এ পাহাড়ে আস্তানা গাড়বে না। বাংলাদেশ সমতল ভূমির দেশ হলেও এর চেয়েও উঁচু পাহাড় এদেশে আছে।
তবে এখানে ভূত না থাকলেও এখান থেকে ২০/৩০ কিলোমিটার পূবে গেলেই ভূত কিংবা অশরীরী অতৃপ্ত আত্মার সন্ধান পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেখানকার এক রেলওয়ে স্টেশনের কাহিনী নিয়ে এদেশের একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক উপন্যাস লিখেছেন। এক ইংরেজ সাহেব তার স্ত্রী ও তার স্ত্রীর প্রেমিককে গুলি করে হত্যা করে ঘরের মেঝেতে পুতে রেখেছিল। উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্স অংশে এই কাহিনী এসেছে। সে উপন্যাসের কাহিনী মনে পড়ায় একটু যে ভয় হয়নি তা নয়। তবে অতৃপ্ত আত্মা সাধারণত তাদের অধিক্ষেত্র ছেড়ে অন্যত্র যায় না।এটাই আপাতত ভরসার কথা।
সে রাতে আর আলো নিভানো হলো না। সকালে ঘুম ভাঙলে পর যথানিয়মে বাথরুমে গেলাম। কাল রাতে পথশ্রান্ত থাকায় ভালোভাবে খেয়াল করিনি। সকালে দেখলাম বাথরুমের জানালায় একটা শিশি, আরেকটা প্লাস্টিকের সাদা কৌটা ঝুলানো রয়েছে। তাতে পরিস্কার অক্ষরে লেখা আছে, কার্বোলিক এ্যাসিড! সত্যি কী
মিথ্যে জানিনে, ছোটোবেলা থেকে জেনে আসছি, কার্বোলিক এ্যাসিড রাখলে ঘরে সাপ প্রবেশ করে না।
কাল রাতে কেয়ারটেকার দ্ব্যর্থহীনভাবে বলল, এখানে সাপ নেই। তাহলে কার্বোলিক এ্যাসিড রাখা হয়েছে কি মেহমান দূরে রাখার জন্য? সরকারী/আধাসরকারী/স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের রেস্ট হাউসগুলো সুযোগ-সুবিধা যেমন, তেমনি সস্তা। বাঙালির বিবেক এতই ধারালো যে, এই সস্তা ভাড়াও না দিয়ে অনেক সময় চলে যায়। তাই মেহমান দূরে রাখার কৌশল হিসেবে কার্বোলিক এ্যাসিডের বোতল ঝুলানো অসম্ভব নয়।
আরো একটা রাত এখানে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সাহসে বুক বাঁধতে পারলাম না।দুপুরের আগেই পাততাড়ি গুটিয়ে কাছাকাছি শহরে হোটেলের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম।
#