মুক্তগদ্য =

নয়নে নহে মোরে চোখ দিয়ে দেখো
হৃদয়ের ডায়েরিটা লিখো

আবু ইউসুফ

লেখক মনের এই গভীর আকুতি যতক্ষণ পাঠকের কর্ণকুহরে না পৌঁছবে, ততক্ষণ লেখক পাঠকের বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে।

লেখক- সাহিত্যিক, গবেষক ও সাধারণের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে কোন বিষয় দেখা ও চিন্তার দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। একই বস্তু একই ভূ-স্থান থেকে একেকজন একেক রকম করে দেখেন এবং বিশ্লেষণ করেন। আধা গ্লাস পানিকে কেউ বলবেন খালি গ্লাস কেউ বলবেন পানিভর্তি গ্লাস, কেউবা বলবেন আধা গ্লাস খালি, কেউ বলবেন আধা গ্লাস পূর্ণ। কিন্তু লেখক বা সাহিত্যিক এখানে ব্যতিক্রম- হয়তো ভাববেন স্বর্গ থেকে আসা কোন অমিয় সুধা, কোন অষ্টাদশী সুন্দরী সাকীর হীরার গ্লাসে পরিবেশন করা মদিরা! এটা কি তরল প্রাণশক্তি না-কী সায়ানাইডের পেয়ালা! বাকী অর্ধেক প্রাণীর বেঁচে থাকার প্রাণশক্তি- অক্সিজেন। অর্থাৎ লেখকের চিন্তাশক্তি কিংবা স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের স্পষ্ট ছাপ পড়বে তার লেখায়।

একসাথে কিছু কুকুরছানা দেখলে সাধারণত আমরা বর্ণনা করি, কতগুলো কুকুরছানা। একজন লেখক আরেকটু গভীরে গিয়ে দেখেন- ঠিক ক’টি ছানা, ক’টি মরদ আর ক’টি মাদি কুকুর, ক’টি কী রঙের, ক’টির চোখ ফুটেছে আর ক’টির চোখ ফুটেনি, চোখের মনি কোনটির কী রঙের, কোনটি মায়াবী আর কোনটি একটু রগচটা ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। তিনি দেখেন কুকুরছানাগুলো ক্ষুধার্ত- রোগে শোকে জীর্ণশীর্ণ। তারপরও ছানাগুলোর মায়াবী চোখের তুলনা করতে গিয়ে হয়তো কোন অষ্টদশী সুন্দরী ললনার কাজলটানা ডাগর ডাগর মায়াবিনী আঁখিও তার সামনে চলে আসতে পারে! প্রাণীকুলের বিশ্বস্ততা, মানুষ নামের কিছু ফানুসের বেঈমানীর তুলনাও আসতে পারে!

পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ নিজেই তার সবচেয়ে বড় বিচারক। নিজের অজান্তেই সে তার নিজের প্রকৃত পরিচয় দিয়ে থাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে। হতে পারে সেটা তার আচরণ, তার কার্যক্রম, স্বগতোক্তি কিংবা তার লেখার মাধ্যমে। এটা সাধারণ মানুষের মধ্যেই ঘটে থাকে। কিন্তু সাহিত্যিকগণ এখানেই সাধারণ মানুষের থেকে একটু আলাদা। মানুষ হিসেবে তাদের লেখায় সাধারণ পরিচয় হয়তো কিছুটা আসবে, পাশাপাশি তার লেখায় সমসাময়িক সমাজের অন্যান্য মানুষের চিন্তা-চেতনা, ভাবনা, ইচ্ছা-আকাঙক্ষা, প্রেম-ভালোবাসা, চাহিদা, লোভ-লালসা, সর্বজনীন বিষয়াদিও প্রকাশিত হবে। এটাই তাকে সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা করে- বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করে।

সাহিত্যিক যখন লেখেন তখন নিজেকে সমাজ, গোত্র ও রাষ্ট্রের প্রতিভূ হিসেবে তার চিন্তা-ভাবনা, লেখা শুধু তার নিজের জন্য থাকে না, সেটা হয়ে যায় সর্বজনীন, সবার। এই সর্বজনীন করার জন্য তার কিছু কমিটমেন্ট থাকে পাঠকের কাছে, সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে। থাকে সাহিত্যের রস ও অলংকার প্রয়োগও। ‘একটি মেয়ে হেঁটে মেলায় যাচ্ছে’ এটি একটি কথা মাত্র। একে শিল্পিত রূপ দেয়া যেতে পারে এভাবে- কলমি-লতার মতো ছিপছিপে কেশবতী এক সুন্দরী ললনা বিছা পরা কোমর দুলিয়ে ধীর লয়ে হেঁটে মেলায় যাচ্ছে! কিংবা কিম্ভুতকিমাকার কৃষ্ণকায় খর্বাকৃতির জলহস্তির ন্যায় এক মহিলা ধপাস ধপাস আওয়াজে হেঁটে মেলায় যাচ্ছে। পরের দু’টা বাক্য সাহিত্য-রসাপ্লুত। প্রথম বাক্যটি শুধুই কথা হতে পারে। লেখককে কথা এবং কথাসাহিত্যের এই পার্থক্যটুকু জানতে হয় এবং মেইনটেন করতে হয়। না হলে সেটা সুখপাঠ্য সর্বজনগ্রাহ্য সাহিত্য হতে পারে না।

সাহিত্যে শেয়ারিং থাকা চাই। অর্থাৎ প্রত্যেক পাঠকের আলাদা আলাদা জীবন চরিতের শেয়ারিং একই সাহিত্যে বাস্তবসম্মত ও বিস্ময়করভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয়। এতে যেমন রাম বলবে এটা আমার জীবনচরিত, ঠিক তেমনি বিপরীতধর্মী রাবণও বলবে এটা আমার জীবনচরিত! এই আলাদা আলাদা জীবনচরিতকে একই প্লাটফর্মে দাঁড় করানোর জন্য লেখককে হতে হয় অনেক কুশলী, ধৈর্যশীল, বিচক্ষণ, পরিশ্রমী, সাবধানী, কল্পনা আশ্রয়ী, রসবোধসম্পন্ন, সপ্ত ইন্দ্রিয়ের সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবহারকারী। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মত পার্থক্য যেমন অতি সাবধানে লেখককে অনুধাবন করতে হয়, তেমনি প্রত্যেকটি চরিত্রের ভেতর নিজেকে প্রবেশ করিয়ে তাদের চোখ দিয়ে দেখতে হয়। সেজন্যে লেখককে কখনো হতে হয় তাপসি রাবেয়া, কখনো দুরাচারিণী, কখনো দাতা হাতেম তাঈ, কখনো দস্যু মকিম গাজী কিংবা কখনো মমতাময়ী মাদার তেরেসা, কখনো দস্যু ফুলন দেবী।


তাই বলে কি লেখক সবকিছু? না, লেখক তার কোনটিই নন। তার নিজস্ব সত্তা যা আছে তিনি তাই আছেন। শুধুমাত্র চরিত্র রূপায়ণের জন্য সময়ের ফেরে নিজেকে চরিত্রানুযায়ী উপস্থাপন করেন। জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ যেমন বাকের ভাই নন, ঠিক তেমনি তিনি বদি কিংবা মুনাও নন। একইভাবে বলা যায় কোথাও কেউ বা নাটকের দর্শকও বাকের ভাই নন। কিন্তু বাস্তবতা ছিলো এই যে কিছুদিনের জন্য দর্শকরা বাকের ভাই হয়ে গিয়েছিলাম। কেউ বা
মুনা। এখানেই লেখক স্বার্থক তার সাধনায়।


আমাদের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন কিংবা চারপাশের অনেকেই নিজের মনপুত না হলে লেখককে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিই। নিজের মত করে মনগড়া কাল্পনিক অভিযোগের আঙ্গুল তুলি লেখকের দিকে। যদিও আত্মবিশ্বাসী লেখকগণ এসব আলোচনা বা
সমালোচনার ধার ধারেন না। কিন্তু নতুন লেখকের মনে উদয় হয় নানা দ্বিধাময় প্রশ্ন।

সাহিত্য-বোধহীনদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা সম্ভব। তাদের সত্য কিংবা মিথ্যা বলেও কনভিন্স করা যায়। তবে সুশিক্ষিত হলে তো কথাই নেই। ইশারার আগেই সব বুঝে নেয়। তাই যারা বোঝার চেষ্টা না করে শুধু বইপড়ার জন্য বই পড়েন কখনো কখনো তারা …ক্যাট্স এন্ড ডগ্সকে নাপাক বিড়াল-কুকুর মনে করে মুষলধারে বৃষ্টির রোমান্টিক সময়টাকেও নাপাক বানিয়ে ছাড়েন!


লেখকের সবচেয়ে বড় জগত হলো তার কল্পনার জগত। যার কল্পনার জগত যত বড়, তার সাহিত্যের মান ও সমৃদ্ধি তত বেশি। লেখকের কল্পনা অনেক সময় স্থান, কাল, পাত্রকেও ছাড়িয়ে যায়। জৈষ্ঠের কাঠফাঁটা খরাতেও তিনি ধরায় নামাতে পারেন শ্রাবণের রিমঝিম বৃষ্টি। শিশিরের ন্যায় ভেজা ঠোঁটকেও বানাতে পারেন গরম, কল্পনায় বাহুলগ্নায়ও পুলকিত হন চরম। তাইতো মহা মুনি বাল্মিকী বলেছেন-


ঘটে যাহা তা সব সত্য নহে,
সে-ই সত্য, যা রচিবে তুমি।
কবি! তব মনোভূমি-
রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।

কল্পনা আশ্রয় নিয়ে রসকষহীন কাঠখোট্টা লেখকও কখনো বনে যান রোমিও, টাইটানিকের জ্যাক, মজনু, ফরহাদ কিংবা চন্ডীদাস। আর তার প্রেমিকা হয় জুলিয়েট, রোজ, লায়লী, শিরি কিংবা রজকিনী। যে লাজুক লেখক নারী দেখায় ভীত, তিনিও চন্দ্রিমা উদ্যানে রাতজাগা ছোট চোখের কোনে কালো দাগ পড়া তিরিশোর্ধ কুচকুচে কালো স্থুলদেহের অদেখা কোন নারীকেও মনের মাধুরী মিশিয়ে বানিয়ে দেন পটলচেরা ডাগরকালো চোখের অষ্টাদশী কোন ললনা, যার গায়ের রঙ দুধে-আলতা, লাউয়ের ডগার মত মেদহীন দেহ। পরম আদরে তার পায়ে পড়িয়ে দেন রূপালী নূপুর, কানে কলমিলতার দুল, খোঁপায় গুঁজে দেন শুভ্র বেলি ফুল। তাকে আটকানোর সাধ্যি কার? তার কল্পনার জগতে তিনি স্বাধীন মহারাজ। তিনি কল্পনায় জল জোছনায় কোন অপ্সরীকে নিয়ে সাঁতার কাটেন, কিংবা টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে পাড়ি দেন কোন পরীর রাজ্য।

#