গল্প=

একটি পূর্ণিমা ও জোনাকির মৃত্যু

জেসমিন নাহার

দ্বিতীয় বিয়ের ফুল শয্যার খাট সাজাতে কিঞ্চিত লজ্জা লজ্জা লাগলেও না সাজিয়ে উপায় ছিল না ওলি আহম্মেদের । কচি বউয়ের বায়না মেটাতে কত কি না করতে হচ্ছে। বেনারশী শাড়ি লেহাঙা, কসমেটিক থেকে শুরু করে খাট সাজানোর ফুল পর্যন্ত। কেনাকাটা সব নিজেই করেছে হবু বউ সামিনা। মানি ব্যাগ আর মালামাল বহনের কাজখানি পেছন পেছন ঘুরে ঘুরে  করে আনন্দে গলা ফুলো পায়রা হয়ে বাকুম বাকুম করতে থাকে ওলি।আনন্দের জোয়ারে  ভাসছে সে। না ভেসে উপায় নেই। পচিশ বছর আগে বিয়ে করেছে। কে কি কিনেছে, বঊ কি পরেছে স্মৃতি থেকে সব ডিলিট হয়ে গিয়েছে। নতুন করে নতুন জিনিস মেমরিতে সেফ হচ্ছে। পঁয়তাল্লিশের ওলি  নিজেকে পঁচিশে দাঁড় করিয়ে গুনগুনায়, আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে… 

প্রথম স্ত্রী সুরাইয়ার গয়না-গাটি  কেচে-কুচে নিয়েছে । নোস পিনটা পর্যন্ত নাক থেকে খুলে নিয়েছে।

সামিনার আবদার, কেউ পরেছে এমন জিনিস আমার শরীরে উঠবে না। পুরনো  জিনিসের ভিতরে পুরনো ছায়া থেকে যায়।

বলতে দেরি, পুরনো গয়না চেঞ্জ করে চার গুণ টাকা ভরে জড়োয়া, টায়রা থেকে  শুরু করে নুপুর পর্যন্ত হয়ে গেল। দুজনাই মনের আনন্দে তা ধিণ তা ধিণ করতে করতে বিয়ের আসরে বসে পড়লো।

সামিনার সাথে প্রেমের খবর জানতে পেরে ওলিকে যখন  জিগ্যাসা করেছে সুরাইয়া, তখন চোরের মায়ের বড় গলায় যে বয়ান করলো তার সারমর্ম হল, আমি একজন সুফি দরবেশ আমারে কয় পরকিয়া? খাড়া তোর গুস্টি উদ্ধার- তোরে ঘরে রাখার পাপ আমার। বাজাইরা মাইয়া মানুষ তোরে বাজারে পাঠায়া পাপ খন্ডানের ব্যবস্থা করতাছি।

ব্যবস্থা আর করা হল না। স্বামীর বদ খাছিলত আটকাতে, তার প্রতি নজর রাখতে রাখতে, তার অত্যাচারে জর্জরিত হতে হতে, সেরিব্র্রাল এ্যাটাকটা হয়েই গেল। পক্ষঘাতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হল সুরাইয়া। একমাত্র মেয়ে স্বামীর সঙ্গে স্যাটেল হয়েছে আমেরিকায়। মায়ের খবর শুনে কেঁদে কেটে দিন পার করছে ।

ছোটা বুয়া দিয়ে সংসার  আর কত দূর চলে? তাইতো তিন মাস না যেতেই এই বিয়ের ব্যবস্থা।

ঘরে ঢুকে নতুন বৌয়ের দাঁত লাগার অবস্থ্যা। চিৎকার করে বলে, ঘরের ভিতর বারগারের চপ কেন?

ওলি  তার ফলি মাছের মত সাদা মুখখানায় কালো মেঘের ছায়া ফেলে বলে, রেস্টুরেন্টের খাবার যা বেশি হয়েছিল সবাইকে দিয়ে টিয়ে বাকিটা ফ্রিজে রাখা হয়েছে। তুমি বারগার পেলে কোথায়? ঐ আইটেমতো আমাদের ম্যানুতেই ছিল না।

চিৎকারের ভলিউম বাড়ে, তুমি বারগারের চপও চোখে দেখ না? ঐটা কি? বলে রুমের অন্য পাশটা দেখায়।

ওহ! ঐটাতো সুরাইয়া। এতদিনতো এ রুমেই ছিল। বিয়ের ঝামেলায় সিফট করতে পারিনি। থাকনা আজ এ রুমটাতে। কাল লোকজন এনে পাশের রুমটায় দিয়ে দিব।

ভলিউম আরেকটু বাড়ে, কি বলছো তুমি, মাথা ঠিক আছে? ওর শরীরটা অসাঢ়, মন চোখতো ঠিক আছে। বেচারি যা-ও ছয় মাস পরে মরতো, আজ রাতেই দম ফেটে মরবে।

ওলি বলে, ও আমার কুঁড়ি কলি প্রবলেম নাই, ওর বেডের সামনে দিয়ে কাপড় টানিয়ে দিচ্ছি।

মধ্যরাতে বার্গারের বন দুপিস আকাশে ডানা মেলে যখন, তখন চপ খানা পাতলা কাপড়ের ও পাশটা দেখে গোঙায় আর চোখের জল ফেলে বালিশ ভিজিয়ে পঁচিশ বছরের স্মৃতি হাতড়ায়। মনে পড়ে নিজের বাসর শয্যার কথা, ভালবাসাবাসির কথা, মেয়ের জন্মের কথা। শেষে স্বামীর অত্যাচারের কথা। বিয়ের দুচার বছর পর থেকেই শুরু হয়েছে পর নারীর নেশা। নারী দেখলেই রঙ রসিকতা বেড়ে যায়। অন্তরঙ্গ সস্পর্ক গড়ে তুলে, নানা রকম কৌশল করে শরীরে পৌছানোর। নারীরাও চাটু বাক্যে মুগ্ধ হয়ে আছাড়ি-বিছাড়ি খায়।

সুরাইয়া প্রতিবাদ করতে গেলেই, কুৎসিত মেজাজে অশ্লীল ভাষায় যা বলে তা সহ্য করার মত থাকে না। তবু সহ্য করতে হয়। স্বামী সন্তান,সংসার বড় আপন। এদের ছেড়ে যাওয়া বড় কষ্টের।

সুরাইয়া কাছের মানুষদের কাছে সব গোপন রাখলেও পাশের ফ্ল্যাটের ভাবীদের কাছে সব ওপেন হয়ে গেল। দেয়ালের কানের শ্রবণ শক্তি যে বড় প্রখর। রুবিভাবী সব শুনে বলে ভাবী আমরাতো আর ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না, মুখে ভাত দিয়েই চলি। পুরুষ এমন জিনিস, ছাই দিয়েও ধরে রাখা যায় না। মাছের মত পিছলা, আর সাপের মত বিষাক্ত। জোরে গিরো দিলে দড়ি ছিড়ে পালায়, ছেড়ে দিলেতো গেল। বৌরা পড়েছে ফাঁটা বাসে। স্বামীদের প্রতি কেয়ারিং হলে বেজায় রাগ, আমায় অবিশ্বাস? কেয়ারিং না হলে, এত অবহেলা? ওরা যে কি চায় নিজেরাই জানে না।

সুরাইয়া প্রথমে বুঝায় পরে হাতে পায়ে ধরে, না পেরে তর্কযুদ্ধে নামে, তারও পরে ঝগড়া ঝাটি করেই পঁচিশটা বছর কাটায়।

পঁচিশ বছরে স্বামি তার কত ছক্কা পেটাতে চেয়েছে, সব ক্যাচ ধরেছে সুরাইয়া। আউট হওয়ার দুঃখে ক্রোধ এবং কর্তৃত্ব দেখিয়ে বৌকে পাপস বানিয়ে রেখেছে। তবুও সুরাইয়া বন্ধন টিকিয়ে রাখার অবিরাম চেষ্টা চালিয়েছে। বুকটা পেতে দিয়েছে স্বামীর অত্যাচারের বুলডোজারের তলায়।

ওলি কলির চাঁদ মধু যাপন, আনন্দ ফুর্তি ঘোরাফেরা করতে করতে সাতদিন কাটার পরে বিষ নিঃশ্বাসবাহি ঘরখানা থেকে মুক্তি পেয়ে সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সুরাইয়া। মনে মনে বলে, আহ সাতটা দিন  নয়, সাতটা যুগ যেন কেটে গেল, ঘর নামের এই হাবিয়া দোযখে। দুজন কামার্ত্য মানুষের মাতিয়ে রাখা রাতগুলি চোখের সামনে দেখে দেখে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েছে। ঈর্ষা হারিয়ে শুধু কষ্টই পেয়েছে। আহ! বড় কষ্ট। এ জীবন চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বে চলে গেছে। এখন শুধুই মৃত্যুর অপেক্ষা।

ওলি কলির মধু মাসের বয়স যখন এক মাস, তখন আতকে উঠে ওলি বলে, সুরাইয়াকে তো এক মাস ধরে কোন ঔষুধ খাওয়ানো হয়নি। বিয়ের ঝামেলায় ভুলে গেছি। ওর ভাই জাফরের তো এ মাসের ঔষুধ নিয়ে আসার সময় হইছে। ঔষুধের বাক্সটা দাওতো ঔষুধগুলি সরিয়ে রাখি।

দুদিন পরে জাফর এসে এক মাসের ওষুধ দিয়ে পুরনো বোনকে নতুন বোনের হাতে সঁপে দিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বিদায় নিল।

ছুটা বুয়ার ঘ্যানঘ্যানানীর সাথে নিজের কথার মিশেল দিয়ে কলিবিবি ওলির সামনে পেশ করে জোরালো ভাবে। মনির মাতো রুগী টানতে টানতে অস্থির । দিনে দিনে  নাকি খাওয়ার যেমন চাহিদা বাড়ছে, ডায়াপার নস্ট করারও কাজ বাড়ছে। বাচ্চাদের হাগামুতা পরিস্কার করতে কষ্ট কম। যোয়ান মানুষেরটা চিন্তা করতে পারো? শুনেছি এ সমস্ত রোগীরা সহজে মরে না। ভারবাহি জাহাজ হয়ে পরিবারের সদস্যদের কাধে ভর করে।

ওর বাপের বাড়ির লোকদের কোন দায়িত্ব নাই? মাসে মাসে কটা ঔষুধ দিয়েই খালাশ? এবার ঔষুধ দিতে এলে ভাইয়ের সঙে পাঠায়া দিবা। না পারলে কোন ভাগাড়ে ফ্যালবা সেটা তোমার দায়িত্ব। আমি বাপু মরা টেনে মরতে পারবো না।

ওলা উঠা রোগীর মত শরীর চুলকাতে চুলকাতে ওলি বলে, ওর বাপ মাতো কবেই মরেছে। ভাইরা যার যার সংসারে। তবুওতো এক ভাই দেখছে। তা ছাড়া ওতো এখনও আমার বিয়ে করা বৌ। বল্লেইতো সব পারা যায় না। সমাজ-নমাজ বলেতো কিছু আছে নাকি?

হ্যা এ বেলায় সমাজতো আছেই। রোগী টানার বেলায় ম্যাথম্যাটিক্স হয়ে যায়। কে করবে কে দেখবে হিসেবের খাতা খুলে বসে। শেষ পর্যন্ত গড়ায় ইতিহাসে।

অত রাগ কর না জানু, সোনাভানু, ময়না-টিয়া-তোতা, ফেলতে পারি তোমার কথা?এবার ওকে কোথাও না কোথাওতো পাঠাবোই । পুরনো চালের ভাতে কি আর মন ভরে? আমরা কাবাব খেয়ে খেয়ে জীবন পার করবো। সেই কাবাবে যদি হাড্ডি বসে থাকে কি যন্ত্রণা কি যন্ত্রণা।

কথার মাঝে মনির মা এসে বলে, ভাবী রোগীর চুল নিয়া প্যাচে আছি। যেমন জট তেমন উকুন ।

কলি, কলকলাইয়া বলে, রোগে ভোগে বাঁচে না, কেশবতী কন্যা হয়ে বসে আছে। ঐ কেশের পরিচর্চা করবেটা কে? উকুনেতো র্ফাম হাউজ ফুলাইয়া ফাপাইয়া তুলবে। মনির মা টাকা নিয়ে পাশের দোকান থেকে রেøড এনে জঞ্জাল সাফ করে ফেল।

কদিন পর সকাল বেলায় সামিনার বকবকানির ঠ্যালায় ওলির ঘুম ভাঙে। চোখ কচলে বলে, কি হয়েছে আমার পুতুলটার?

কি হয়নি? মনির  মার পাখনা গজিয়েছে। লোভী মাকড়সার মত কোমরে পাঁচ ছয়টা দড়ি বেধেছে। একা মানুষ এতগুলি বাসায় কেমনে কাজ করবি? দুদিন এলে তিনদিন কামাই। ওদিকে মরাটাও মরি মরি করে মরছে না। দুদিন ধরে গুয়েমুতে ডুবে আছে। গন্ধে ঘরে যাওয়া যাচ্ছে না। খাবার-দাবারও দিতে পারছি না। আমিতো সতীন, না দেখলে নাই। তুমিতো পঁচিশ বছর সংসার করছো, ওর স্বামী। তুমি পার না একটু দেখভাল করতে? বাড়িতে বেড়াল পুষলেওতো মানুষের মায়া মমতা থাকে। খোঁজ খবর রাখে।

ওলির চোখদুটো কপাল ছাড়িয়ে মাথায় উঠতে চায়। ডেংগু জ্বরের রোগীর মত কোকায়ে বলে, তুমি বলছো? তাহলেতো খবর রাখতেই হয়। তুমি মাইন্ড করবে বলে আমি ওর ঘরেই ঢুকিনা। দাও দেখি কিছু খাইয়ে আসি।

সাগুর বাটি হাতে নিয়ে নাক চেপে সুরাইয়ার পাশে বসে আঁতকে উঠে, ওলি মনেমনে বলে, একি সেই সুরাইয়া? এতো পাতলা চামড়ায় ঢাকা কখানা হাড়গোড় মাত্র। এত দিনে একবারের জন্যও কি আমার চেখে বা মনে পড়লো না? কাপা গলায় ডাকে, ঘুমাইছো নাকি? হা কর একটু সাগু খাও।

নড়াচড়া নাই, গোঙানিও নাই। ওলি মনে মনে বলে, নতুন বিয়ের তিন মাস হলো এক দিনের জন্যও ওকে একটু ছুঁয়েও দেখি নাই। জ্বরটর হলো নাকি? কপাল ছুঁয়ে আতকে উঠে। সামিনা এদিকে এসে দেখ ওর শরীর ফ্রিজের মাছ মাংশের মত ঠান্ডা হয়ে গেছে। মরে টরে গেল নাকি?

সামিনা এসে নাক চেপে বলে, মনির মা দুদিন আসে না, তবেকি দুদিন আগেই মরে পড়ে আছে। তবু ভালো আমাদের বাঁচায়ে দিয়ে গেল, মরে  নিজেও  বাঁচলো। ওর ভাইয়ের বাড়ি খবর দাও। তার আগে মনির মাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলি, লোকজন আসার আগে গায়ের নোংরা কাপড়গুলোতো চেন্জ করা লাগবে।

বোনের লাশ মাটি দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে জাফর। ওর কান্না দেখে ওলি মনে মনে বলে, শেষ পর্যন্ত কারো কান্না দেখে আমার চোখে পানি আসলো। পোড়া চোখ মরুভূমি হয়ে গেছে। পানিতো আসতে চায়ই না শুধু বালি আসতে চায়। এ দিকে মরা বাড়ি বলে কথা। চোখ মুছতে মুছতে বলে, ভাই জাফর বাইরে প্রচন্ড গরম পড়েছে, চল ঘরে বসে একটু জিড়িয়ে যাবে।

ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে তিনজনই। জাফর বোনের ছোট ছোট স্মৃতি মনে করে বলে আর চোখ মুছে। ওলিও তার পঁচিশ বছরের দাম্পত্য জীবনের সুরাইয়ার যত  স্মৃতি আছে সেগুলি বলে যায় অকপটে। মনের অজান্তে? না, জেনে বুঝেই বলছে? সেটা ভাবতে গিয়ে বুঝতে পারে তার মনের ভিতরের বরফের চাঁইটা গলে যাচ্ছে একটু একটু করে। মনের গভীরে যেই মনটা আছে, সে গোপনে  কেঁদে উঠে, হায়! সত্যিই আমার জীবন থেকে বড় কিছু হরিয়ে গেলো বুঝি। কষ্টের পাথরখানা ঝেকে বসলো বুকের মাঝে।

মনির মা, ঠান্ডা পানি দিয়ে এক গ্লাস লেবু সরবত দাওতো, জাফর ভাইয়ের জন্য, বলে সামিনা মুখের ঘাম মুছে।

 কৃতজ্ঞতা আর মমতা মেশানো কন্ঠে জাফর বলে, বোন সামিনা, আর ওলি ভাই আপনারা আপার জন্য যা করেছেন জীবনে ভুলবো না। ঠিকমত ঔষুধপথ্য খাইয়েছেন, দেখেশুনে রেখেছেন । আমরা চির কৃতজ্ঞ আপনাদের  কাছে।

কথার মাঝে মনির মা সরবতের চিনির বৈয়মের জন্য সোকেসের নিচের পার্টের কাঠের পাল্লা টানতেই জাফরের কিনে দেওয়া তিনমাসের না খাওয়ানো লুকিয়ে রাখা জমানো ঔষুধগুলি ঝপাৎ করে ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়ে। যা কিনা আজ রাতেই ফার্মেসিতে অর্ধেক দামে বিক্রির কথা বলে রেখেছিল সামিনা আর ওলি।

#