গল্প =
নদী-গ্রাম ও নারীর কথা
জামাল উদ্দিন জামাল
টুনটুনি ওর ছদ্ম নাম। কিন্তু আমার ইচ্ছে হচ্ছে, চিৎকার দিয়ে আসল নাম বলে দেই। চিৎকার দিয়ে বলি আমি তোমাকে ভালোবাসি। না বলা যাবে না। তবে এখনও জোৎস্না রাতে আকুল হয়ে বারান্দায় বা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকি টুনটুনির দেখা পাবো বলে। আর রাতের আঁধারে যদি শ্রাবণের অবিশ্রান্ত ধারা নেমে যায়। অন্ধকার বারান্দায় বসে থাকি। এই বৃষ্টির অন্ধকারে বারান্দায় বসে থাকতে ভালো লাগে বলে আমার পাগলি মেয়েটি বৃষ্টি আসলে ডেকে বলবে, বাবা বারান্দায় বসবে না? মেয়ে বলে চলো আমিও তোমার সাথে বসি।
টুনটুনি আমার ক্লাস ফ্রেন্ড। ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত একই সাথে পড়াশোনা করেছি।
শ্যামবর্ণের, চোখ দুটো কুচকুচে কালো, লম্বা ৫ ফুট। খুব মানানসই। প্রভাবশালী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে মেয়ে। এই ৫ বছরে তিলতিল করে কঠিন বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। হৃদয় দিয়ে বুঝেছি, আমার প্রতি টুনটনির অনন্ত প্রেম। সে প্রেম বিয়ে করার জন্য নয়। এ প্রেম হচ্ছে একটি ছেলের অন্য এক ছেলের যেমন বন্ধুত্ব হয় তেমনি। যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন সবার কাছে বিষয়টি ওপেন হয়ে যায়।
মানুষ কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে। কেউ বলে এই পিচ্চি পোলা এখনই প্রেম করে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ার আগেই পরিস্থিতি শামাল দিলাম। ক্লাসে বা ক্লাসের বাইরেও কথা বলি না। আমার প্রাণের স্কুলের নাম চৌধুরী মালঞ্চ। স্কুল থেকে টুনটুনিদের বাড়ি আর আমাদের বাড়ি পুরোপুরি বিপরীতমুখী। স্কুল ছুটি হওয়ার সময়, চোখে চোখে এক পলক কথা হয়। এই এক পলকই তো হাজারো কথা। হৃদয় দিয়ে বুঝে নেই। না বলা কথার মানে খুঁজে নেই। আমার বুকটা ফেটে যায়। সমাজের গুষ্টি কিলাই। অবশ্য ওদের পরিবার থেকে কখনো কিছু বলে নাই। অকাজের মানুষ, স্কুল শিক্ষক ও স্কুলের ছেলেমেয়েরা যতো সব রটনা রটাতে থাকে। চৌধুরী মালঞ্চ গ্রামের পশ্চিম পাশে আমাদের গ্রাম। গ্রামের নাম নন্দবালা, ওদের গ্রামটা স্কুলের পূর্ব পাশে চৌরাকররা। দূরত্ব অনেক। আর মাত্র দু’মাস পরেই টেস্ট পরীক্ষা। তারপর এসএসসি পরীক্ষা।
এসএসসি পরীক্ষার জন্য নতুন ড্রেস বানাতে গিয়েছি মালঞ্চ গ্রামের নামি দামি লেবু খলিফার কাছে। বাড়িতে ফিরে দেখি টুনটুনি ওর ছোট বোন মুনমুনকে নিয়ে এসেছে। রীতিমত মেজবানি খাচ্ছে। চৌকিতে বসে খাওয়া দাওয়া করছে। মা ওদের খুব আদর যত্ন করে খাওয়াচ্ছে। আমি তো অবাক। কি করে সম্ভব। ভয়ঙ্কর ব্যাপার। আমাদের গ্রামের পশ্চিম পাশে ধলেশ্বরী নদী। পূর্ব পাশে বিল, তার পূর্বে আরো একটি বিল। সেই সময় আমাদের এই গ্রামটি খাল-বিল, নদী-নালা একেবারে জালের মতো বিস্তার করে রেখেছিল। শুষ্ক মওসুমেও স্কুলে যেতে তিনবার করে জুতা খুলতে হতো। আমার মা আবার আগে থেকেই চিনতো। ওরাতো মার আদরে মহাখুশি। টুনটুনির ভিতরে কোন দুর্বলতা নেই। খুবই স্বাচ্ছন্দ বোধ করছে। মার সাথে জমিয়ে ফেলেছে। আমি ওর মায়াবি মুখ আর কাজল কালো চোখের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। সাদা ঝকঝকে দাঁতগুলো বের করে হা হা করে উচ্চস্বরে একটা হাসি দিয়ে বলে উঠলো।
: আরে তুমি বসো না কেন? আমাদের সাথে খাও।
: খাবো তো, কিন্তু তুমি আসলে কিভাবে?
সে বললো, তুমি প্রতিদিন যাও আর আমি একদিন আসতে পারবো না। প্রথম একজন নৌকা দিয়ে বিল পার করে দিয়েছে, আর এই বিলে কাপড় কাচে, এভাবেই চলে এলাম। খালাম্মার কাছে পরীক্ষার জন্য তো দোয়া নিতেই হয়। তুমি এতো ভয় পাও কেন? শোন, খাওয়া শেষ হলে তোমাদের গ্রামটা আমাকে একটু ঘুরে ঘুরে দেখাও।
আমি বললাম, তোমাদের গ্রাম আর আমাদের গ্রামে দেখার পার্থক্যটা কি?
: অনেক পার্থক্য আছে। আমাদের ওখানে নদী নেই।
এরই মধ্যে মা বলে উঠলো, তোর এতো কথার দরকার কি?
দেখতে চাইছে, দেখা।
টুনটুনি বলে উঠলো, এবার- খালাম্মা বলেছে যেতে হবে।
মা’র সামনেই বলে ফেললো, আমি কিন্তু তোমার হাত ধরে এ পাড়া থেকে ও পাড়ায় ঘুরে বেড়াবো।
আমিও টুনটুনির কথা শুনে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ভেতরে ভেতরে পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছি। ওহ! কিশোর বয়সের অবুঝ ভালবাসা। নদীর ঢেউ কি কখনো বেঁধে রাখা যায়। এইজন্য তো বিখ্যাত কণ্ঠ শিল্পী আব্দুল আলীম গেয়েছেন, ‘পরানে আর সইবো কতো, আগুন জ্বলে মনে, মনের আগুন জইলা মরে, বনের আগুন দেখতে পারে।’
টুনটুনি বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মাকে কদমবুচি করে বললো, দোয়া করবেন, আমি যেন পাস করতে পারি। ছোট বোন মুনমুনকেও বললো কদমবুচি করতে। বাড়ি থেকে বের হয়ে বায়না ধরলো, ধলেশ্বরী নদীর ভাঙ্গন দেখবে।
: সাথেই নেই না, আবার কোলে। বিস্তৃত ফসলের মাঠ, ধানী জমি ও ঘর বাড়ি। নদী গ্রাস করে ফেলছে। কতো লোকের আহাজারি। আর তুমি আছো নদীর ভাঙ্গন দেখবে। ঠিক আছে চলো।
বাম হাতটা সে দু’হাত দিয়ে চেপে ধরলো। হাঁটতে শুরু করলাম। সাধারণত: টুনটুনি কখনই শাড়ি পরে না। আমাদের সময়ে অর্থাৎ ’৭৫-৮০ সনে মেয়েরা একটু বড় হয়ে স্কুল কলেজে পড়াশোনা করতো। এই কারেণ আইএ ক্লাসে উঠেই মহিলা কলেজগুলোতে কলেজ ড্রেস ছিলো শাড়ী। তো টুনটুনি দশম শ্রেণীতে উঠে একবার সখ করে শাড়ী পরে স্কুলে এসেছিলো। আবার আজকে পাতা রংয়ের শাড়ি পরে এসেছে। মানিয়েছে সেই রকম। সবুজ শষ্য ক্ষেতে বাতাসে যেমন ঢেউ খেলে যায়, মনে হয় ওর কোমরের ঢেউয়ের কাছে সব হার মেনে যায়। কোন কারিগর যে ওকে এইভাবে শাড়িটা পরিয়ে দিলো। হাত ছেড়ে দিয়ে শাড়িটা গুটিয়ে নিয়ে আবার হাত ধরে পথ চলতে লাগলো।
পথ চলতে চলতে টুনটুনি বলতে থাকে, ভয় পেয়ো না। বন্ধু আছো বন্ধুই থাকবে। এর বেশী পা বাড়াবে না। তোমার আমার বিয়ে হতে পারে না। তোমার আর আমার বয়স সমান সমান। তোমার বিয়ে করতে হবে কতো বছর পরে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আমার হয়তো ২/৩ বা সর্বোচ্চ ৪ বছর। আমি মনে মনে বিস্মিত হচ্ছি ওর পাকনা পাকনা কথা শুনে। ক্লাসে দেখে, ওর আচরণে বা কথাবার্তায় মনে হতো ভাজা মাছটাও উল্টিয়ে খেতে পারে না। আজ দেখছি পেকে গেছে। ওর ছোট বোন তো সাথেই আছে।
আমি বললাম, কিন্তু এমনি করেই তো একদিন প্রেম হয়ে যায়।
আহ! চট করে আমার দিকে তাকালো। তাকিয়ে আছে তো আছেই। কোন শব্দ নেই। চোখের পলক ফেলছে না। কতো না বলা কথা। ওর ভিতরের মানুষটার ভিতরে অন্য রকম এক অনুভূতি। মেয়েদের প্রেম। সেই চাহনি আজও ভুলতে পারিনি। একি ভোলা যায়। জীবনের এই অপরাহ্ন বেলায় এসেও সেই দৃশ্য মানসপটে ভেসে ওঠে। আমি এতে সুখ পাই। যাক, হাঁটতে হাঁটতে ধলেশ্বরীর পাড়ে গেলাম।
বললাম, দেখো, নদী দেখো। প্রাণ ভরে দেখো। পাল তোলা ছৈওয়ালা নৌকা, শষ্য ক্ষেত কিভাবে সর্বনাশা নদী ভেঙ্গে নিচ্ছে দেখো।
টুনটুনি বললো, আচ্ছা, তুমি একটা গান শোনাবে?
: না, এখন না। মুড নেই। নদী মানুষের সব কিছু বিলীন করে নিচ্ছে। মানুষের কি কষ্ট। আর তুমি আছো গান নিয়ে।
: আচ্ছা বিলের পারে গিয়ে নৌকায় উঠে শোনাবে। আচ্ছা সেদিন স্কুলে গান পরিবেশন করার সময় ছুটে এসে গানের স্যার তোমাকে থাপ্পর মারলো কেন?
প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললাম, দেখো দেখো নৌকাটা মনে হয় ডুবে যাচ্ছে। কতো বড় বড় ঢেউ, কি স্রোত। এতে কাজ হলো না।
আবার সেই বায়না, স্যারে থাপ্পর দিয়েছিলো কেন?
আমি বললাম, সেদিনের সেই গানটা ছিলো খুরশিদ আলমের। গানের একটা অন্তরা ছিলো এরকম ‘কোমলও অঙ্গে যেন কোন ব্যথা সে না পায়।’ আমি ইচ্ছা করে বলেছিলাম ‘গোপনও অঙ্গে যেন কোন ব্যথা সে না পায়’।
: তুমি সেটা বললে কেন?
প্রথমত: স্যারে জানেন, এটা আমি ইচ্ছা করেই বলেছিলাম। এতে দর্শক শ্রোতারা আলাদা মজা পায়। যাক বাদ দাও। এখন বাড়ি ফেরা যাক।
: গান শোনাবে না?
: কোন গান শুনবে?
: কবি শামসুর রাহমানের লেখা, ‘স্মৃতি ঝলমল সুনীল গাছের নিচে, পানি টলমল মেঘনা নদীর কাছে, আমার অনেক ঋণ আছে ঋণ আছে। প্রতিদিন লাল দিগন্তে সূর্য উঠে হাসি ছড়িয়ে, কাজল দীঘির প্রান্ত বুকে পদ্ম ফোটে শোভা ছড়িয়ে। আমার অনেক ঋণ আছে, ঋণ আছে…
টুনটুনির বারবার বলার পর গাইলাম। প্রাণ খুলে আরো কয়েকটি গান গাইলাম।
আচ্ছা তুমি তো ভালো গাইতে পারো। তুমি একটা শোনাও।
: আচ্ছা ঠিক আছে দু’জনে দ্বৈত কণ্ঠে গাই। ওই যে ‘স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা’ ছবিতে রাজ্জাক আর ববিতা ঠোঁট মিলিয়েছে। কি আমার সাথে গাইতে পারবে না।
: ঠিক আছে চেষ্টা করে দেখি।
নীল নীল আহা কতো নীল/ তোমারই দুটি চোখ/ যেন আকাশের চেয়ে বেশী নীল/ না-না ওগো সেতো নয়/ আমার এ দুটি চোখ করে/ তোমার প্রেমে ঝিলমিল/ নীল নীল আহা কতো নীল…/ বিদিশার নেশা যেন/ তোমার ওই কালো চুল/ না না সেতো নয়/ হয়তোবা দৃষ্টির ভুল/ভুল হোক ক্ষতি নেই/ তবু ভালো লাগে/ তোমার ওই গড়মিল/না-না ওগো সেতো নয়/ ভালো যে বাসো তাই/ লাগে রঙ্গীন যেন ঝিলমিল/আঁধারের মত কি যেন তোমার ওই/ কপালের তিল/ না-না পাবে না তিলোত্তমার কোন মিল/ নীল নীল অতি নীল আবার তবু যেন/ তরু এ রাতের কতো স্বপ্নীল/ না-না ওগো সেতো নয় তুমি আছো পাশে/ তাই স্বপ্ন নামে অনাবিল/ নীল নীল আহা কতো নীল/ তোমারও দুটি চোখ যেন আকাশের চেয়ে মিল।
গান শেষ হওয়ার পর আমি বললাম, আবার আমাদের বাড়ি হয়ে যাওয়ার দরকার নাই। তোমাকে নদী পার করে রাস্তায় উঠিয়ে দিয়ে আসি।
খেয়া দিয়ে নদী পার করে দিয়ে এলাম। সেই দিনটির কথা আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠে প্রায়ই। মেঠোপথ দিয়ে অনেক হেঁটেছে, আমার গ্রাম আমার প্রাণ।
সেদিনের অনুভূতি আর আজকের অনুভূতি এক নয়। সেই মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া। পথের পরে পথ তবুও সবুজ ফুরায় না। সেদিনের সেই গ্রামের বাড়ির খোলা আকাশ, উতাল করা বাতাস, পাশেই ধলেশ্বরী নদী, নদীর ঢেউ এসে মনে হয় আমার বুকে লাগে। গোধুলি বেলার পাখির কাকলি মনটাকে সত্যি ভাবুক করে দেয়। মনে হয় আবার যেন হারিয়ে যাই। রাতের মেঘমুক্ত আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ, সেই সাথে কেজি ভাই’র লেখা ‘তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে’ গান মনটাকে আরো রোমান্টিক করে দেয়।
সময় গড়িয়ে গেল। এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হলাম। মনটা ভীষণ খারাপ ছিল একটা বছর। টুনটুনি আমাদের সাথে পাস করতে পারেনি। পরের বছর পাস করে। কিন্তু আমার সাথে একই ক্লাসে না পড়তে পারলে তো দূরত্ব বেড়ে যাবে। তাই হলো। আমি আর টুনটুনি চাইলেই তো আর হবে না। সৃষ্টিকর্তা যদি না চান। তাই হলো। সেই বাস্তবতায় দূরে চলে গেল টুনটুনি।
দু’চারবার দেখা হয়েছে। কিন্তু ভুলতে পারিনি। কখনো কখনো মানুষের চোখের আড়ালে কেঁদেছি। মনকে বুঝ দিয়েছি। আমি তো আর তাজমহলের নমুনা রাখতে পারবো না। টুনটুনি আমাকে কখনই বিয়ে করতে চায়নি। আসলে আমি ভালো লাগার ও ভালোবাসার মতোই একজন মানুষ। সংসার করে ধনী হয়ে যাবো এমনটি কেউ আমাকে নিয়ে ভাবেনি। আর আমাকে অন্তর দিয়ে ভালো বেসেছিলো টুনটুনি। আমি বিয়ে করার আগ পর্যন্ত বাড়িতে গেলে মা জিজ্ঞাস করতো, ওই মেয়েটি কেমন আছে? তোর সাথে দেখা হয়?
আমি অনেকক্ষণ কথা বলতে পারিনি। স্বাভাবিক হওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে যেতাম। বলতাম, মা আমি আসছি। স্বাভাবিক হয়ে এসে বলতাম। ভালোই আছে। দেখা হয়।
টুনটুনি বিয়ের জন্য সেই কিশোর বয়সে আমারই এক বন্ধুকে ঠিক করে রেখেছিলো। তার নাম মনোয়ার। কারণ হলো, মনোয়ার চেয়ারম্যানের ছেলে, চেহারা ছবি আমার চেয়ে ভালো। কিন্তু সেটা তার ভাগ্যে হয়নি।
টুনটুনি এসএসসি পরীক্ষায় একবার অকৃতকার্য হলেও ছাত্রী হিসাবে খারাপ ছিলো না। ধৈর্য সহকারে বিএ পাস করে একজন সরকারি অফিসার হয়ে গেল। অন্য জেলার একটা ভালো ছেলের সাথেই বিয়ে হয়ে গেল। মনোয়ার এগুতে পারলো না। বাবা চেয়ারম্যানও নাই। বেচেকিনে খেয়ে সব শেষ করে দিয়েছে।
টুনটুনির কথা মনে করেই গ্রামে যেতে ইচ্ছা হয়। যদি দেখা হয়। দেখা হয় না। ওর দেখা না পেলে গ্রামটা আমার কাছে হাহাকার লাগে। স্কুলের পাশে বন্ধু আজিজদের বাড়িতে টিফিন আওয়ারে আমি টুনটুনি আরো দু’একজন কতো আড্ডা জমিয়েছি। মনে হলে অঙ্গার হয়ে যাই, আবার সুখও পাই। ওকে ভাবতে আমার কতো ভালো লাগে। মনে হয় এখনই গ্রামে চলে যাই। কিন্তু থমকে দাঁড়াই। টুনটুনিও নাই, ভালো লাগার সব দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। অবারিত সবুজের সীমানা নেই, স্কুলের সেই বড় বট গাছটা নেই। নদী নেই, মাঝি নেই, খেয়া নেই, কিশোরদের হৈ হুল্লা নেই, মানুষের সাথে মানুষের মমত্ববোধ ছিলো সেটাও নেই। ছেলে-পিলেদের মুসলমানি বা বিয়ে বাড়িতে লাঠি খেলা, গোল খেলা নেই; নৌকা বাইচ নেই, আব্দুল আলীমের পল্লীগীতি নেই, পল্লী কবি জসিম উদদীনের কবিতা নেই এবং কোন সুখপাখিকে দেখা যায় না। এখন আর নববধূরা নাইওর যায় না। স্কুলের মাঠ আছে, খেলাধূলা নেই। এখন সেখানে অর্থ আছে, বাজার আছে। গ্রামের মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকান আছে, আড্ডা আছে। সেখানে গড়ে উঠছে কাল মার্কস, লেলিন ও মাওসেতুং। চলে রাজনীতির আলাপ। মুরগি নিয়ে ঝগড়া হলেও দুটি রাজনৈতিক দলের দাঙ্গা-হাঙ্গামায় পরিণত হয়ে যায়। সেখানে কি আছে?
‘ধু ধু বালুচরে মেঘনার পাড়ে তুমি আমি লিখি গানের বর্ণমালা।’ ‘যেখানে রমণীগুলো নদীর মতো, নদীও নারীর মতো কথা কয়’।
আমি যেখানে নদী পারাপারের জন্য নৌকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। সেখানে গিয়ে আমি এখন পাথরের মতো অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে দেখি। এই আমার গ্রাম। কি বেহাল অবস্থা। রাজনীতির কারণে অথবা সম্পদ ভাগাভাগির কারণে ভাইয়ে ভাইয়ে, পিতা-পুত্রের দ্বন্ধ লেগেই আছে।
প্রযুক্তির কারণে বদলে গেল আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি। আর প্রযুক্তির কারণে টুনটুনির যোগাযোগটা বেড়ে গেল। মোবাইল ফোনে কথা হয়। ওর ছেলেমেয়েরা অনেক ভালো করেছে। কতো কাহিনি, হাসি ঠাট্টা টেলিফোনেই জমে উঠলো।
একদিন সকালে টুনটুনি ফোন করলো, ভাবী আছে বাসায়?
: না।
: সৌভাগ্য আমার।
আমি বললাম, তোমার ভাবীর মনটা অনেক বড়। তোমার সাথে যোগাযোগ হয়। ভালো সম্পর্ক আছে। সবইতো জানে। তুমি আমার একজন ভালো বন্ধু।
: নারে ভাই। সেটা না। আমি তোমাকে যে কারণে ফোন করেছি এবং সে কাজটি যদি তুমি করো- তাহলে ভাবী তোমাকে এই সকালে বলবে যে, আমার স্বামীটা নিশ্চিত পাগল হয়ে গেছে।
: তোমার সেই গানটা আমার কানে আজো প্রতিধ্বনি হয়ে বেজে ওঠে। একটু শোনাও না ভাই। ঐ যে, নাদিম-শাবানা অভিনীত আনাড়ি ছবির একটি গান, ‘লেখা পড়া জানতাম যদি তোমাকে চিঠি লিখতাম।’
গানটি শোনালাম। কী যে খুশি হলো ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়। এটাই ওর সাথে শেষ সংলাপ। জীবনের শেষ ইচ্ছা ছিলো কোন এক ঈদের ছুটিতে ছেলেবেলায় যা করতাম, সেই পথ দিয়ে সেভাবে আমার হাত ধরে হাঁটবে। কিন্তু বিধি কপালে রাখেনি। কিছুদিন পর হঠাৎ হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে চলে যায় না ফেরার দেশে। এইতো জীবন- এইতো মরণ। মনে হয় যেন চোখের পলকের মতোই এই জীবন।
আমার সুদূর অতীতকে সোনালী অথবা রূপালী অতীত বলবো কিনা জানিনা। জীবনে সংগ্রাম, দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ-বেদনা যাই থাকুক জীবনের এই শেষ বিকেলে ভাবতে আমার অনেক ভালো লাগে। কখনো বসন্ত কখনো শ্রাবণ এরই নাম জীবন। কারো জীবনের গতি থেমে থাকে না। টুনটুনির মতো সবাইকে চলে যেতে হবে।
#