স্মৃতি-গদ্য =

ছবির ফ্রেমে, পাকশীর প্রেমে

মুস্তাফা মহিউদ্দীন

আট বছর আগের একদিন =

গত সপ্তাহে (২০১৬ সালের আগষ্টের শেষ সপ্তাহে) এক ঝটিকা সফরে গিয়েছিলাম ইশ্বরদী ও পাকশী। সকাল ৬ টায় ছেড়ে আন্তঃনগর ধুমকেতু ইশ্বরদী পৌঁছায় সকাল ১০-৪০ শে। ছাড়লো এক ঘন্টা দেরীতে, পৌছলো এক ঘন্টা পর।দিনের প্রথম ভাগ ইশ্বরদীর কাজ সেরে, খেয়ে দৌড়াবো পাকশী। ওখান থেকে ফিরে ঐ দিনেই বিকেল পাঁচটার পদ্মা ট্রেন ধরে ইশ্বরদী থেকে ঢাকা।

পাকশী আমার কাছে এক স্মৃতি জাগানিয়া নাম। ইশ্বরদী উপজেলার অধীন পাকশী একটি ইউনিয়ন হলেও রেলের বিভাগীয় সদর দপ্তর। আমার চাকুরীর শুরুর দিকে ১৯৮৩-১৯৮৫ এর সময় আমি সেখানে ছিলাম বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা বা ডিসিও হিসেবে।যারা ঢাকাকেন্দ্রিক জীবন-যাপনে অভ্যস্ত তারা ভাবতেও পারবেন না পাকশী কী অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় শহর! ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কে ঘিরে বৃটিশরা এই রেলশহরটি গড়ে তোলে তাদের মত করে পদ্মার পারে।

বাঁধের পাশে হার্ডিঞ্জের কোল ঘেঁষা অফিসার্স কলোনি, লাল ইটের একতলা /দোতলা বাংলো বাড়ি, পুরো রেল শহরটি রেইনট্রি, সেগুন, শিরিষ, কৃষ্ণচূড়া, নাগকেশর গাছে ঘেরা। ফলের মধ্যে লিচু, জাম,আম গাছের সারি। ভেতরে সব পাকা রাস্তা, কোথাও হেরিংবোন লাল ইটের। পথে পথে ঝরা পাতা বিছানো। অসাধারণ জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা। ছিমছাম নিস্তরঙ্গ রেল শহর পাকশী — পথে পথে শোনা যায় পাখির ডাক।

আমি প্রথম পাকশীর কথা জানি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু আখতার (আখতারুল হক, সিনিয়র সাংবাদিক অবজারভার) এর কাছ থেকে। ও ছোটবেলা পড়েছে পাকশী চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ এ।ওর বাবা ড. শামসুল হক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আই ই আর এর পরিচালক) প্রথম জীবনে ছিলেন চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ এর প্রধান শিক্ষক। আখতারই জানায় কবি শঙ্খ ঘোষও পড়েছেন ঐ স্কুলে, তারও ছেলেবেলা কেটেছে পাকশীতে দেশভাগের আগে।

আমি যখন প্রথম পাকশী পোস্টিং নিয়ে যাই, নেমে প্রথম মনে হলো, এসেছি কবি শঙ্খ ঘোষ এর ছেলেবেলার শহরে। ততোদিনে আমি পড়ে ফেলেছি কবি শঙ্খ ঘোষের ছোটদের উপন্যাস ‘সকাল বেলার আলো’ –দেশভাগের আগে পাকশীর পটভুমিতে লেখা অসাধারণ উপন্যাসটি যারা পড়েছেন নিশ্চয়ই অনুধাবন করবেন কতটা প্রভাবিত করেছিল তাঁকে তাঁর পাকশীর শৈশব -কৈশোর। কবি শঙ্খ ঘোষের বাবা মণীন্দ্র ঘোষ ছিলেন ব্রিটিশ আমলে চন্দ্রপ্রভা বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার, শঙ্খ ঘোষও ঐ স্কুলের ছাত্র। আমি চাকুরী কালে তিনি একবার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ এর সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসেছিলেন, তাঁর বাল্যবন্ধু নিয়ামাত মাস্টার (পাকশী রেলওয়ে গার্লস স্কুলের শিক্ষক) আমি তাঁর ভক্ত জেনে আমার চেম্বার এ নিয়েও এসেছিলেন। কিন্তু দূর্ভাগ্য আমার আমি তখন ট্যুর এ ছিলাম খুলনা। পরে অবশ্য তাঁর সংগে দেখা হয়েছে ঢাকায়। পাকশীতে আমি ছিলাম, প্রসংগ উঠতেই উচ্ছসিত হয়ে উঠেন তিনি, তাঁর স্ত্রীকে ডেকে বলেন এই শোন পাকশীর ডিসিও কে পেয়েছি। তাঁর গিন্নী জানালেন পাকশীর প্রসংগ পেলে তিনি অন্য আলাপ ভুলে যান। তিনি স্বীকার করলেন পাকশী তার প্রথম প্রেম, তিনি ভুলতে পারেন না শৈশবের শহর পাকশীকে।

পাকশীর এক অন্য মায়া আছে ; আমিও ভুলতে পারিনা প্রথম যৌবনে আমার পাকশীতে চাকুরী করার স্মৃতি। সেই পাইলট ট্রেন, লাল ইটের অফিস, বৃটিশ আমলে করা বিশাল বাংলো বাড়ি, বাংলোর সামনের লনে হলুদ সর্ষে ফুলের বাগান (আমার পিয়ন শহিদ লাগিয়েছিলো, আমি বলেছিলাম সর্ষে তোর, ফুলের শোভা আমার), সেই সুবিন্যস্ত পায়ে হাঁটা পথ, পদ্মার বাঁধ, ইলিশের নৌকো, হার্ডিঞ্জ ব্রিজে ট্রেন চলার গমগম আওয়াজ, রাতের কর্মব্যস্ত রেলকন্ট্রোল রুম, মাহবুব আলী ইনিস্টিটিউট এ রেলকর্মচারীদের নাটোৎসব, রেলস্কুল মাঠে ছেলেদের ফুটবল খেলার হই-হুল্লোড়, রুপপুর, শাহপুর -বাঘইল গ্রামের মানুষদের রেলকেন্দ্রিক জীবনের কলতান –সব সব মনে পড়ছে।

এবার পাকশীতে গিয়ে বড়ো স্মৃতি ভারাতুর হয়ে পড়লাম। অধিকাংশ স্টাফই অবসরে। দু’একজনকে পেলাম যারা আমাকে দেখে চিনতে পারলো ও যথারীতি আবেগাপ্লুত। ওদের সংগে ছবি তুললাম। সব আছে আগের মতো, শুধু আগের মানুষগুলো নেই। জীবন বহমান, শুধু আমরাই আমাদের পছন্দের জায়গাগুলোয় থাকিনা। পাকশীকে আমি কখনো ভুলবো না।

আমার স্ত্রী-সন্তানরা জানে আমি পাকশী-অন্ত প্রাণ। ওরা অবাক হয়, কী করে বলি আমি পাকশীর প্রেমে পড়েছিলাম জীবনের প্রথম যৌবনে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে ট্রেন চলার সময় জানলায় মুখ বাড়িয়ে চোখে পড়ে পাকশীর ঘন সবুজ অরণ্য, বাইরে থেকে দৃষ্টিনন্দন সবুজ, কিন্তু পাকশীতে না থাকলে বোঝা যায়না এই অরন্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে কতো রোমাঞ্চ আর রহস্য!

পাকশীর স্মৃতি আমার লাল যৌবন দিনের চকমকি পাথর হয়ে থাকবে আজীবন।

#