বহুল আলোচিত গল্প=

গলির ধারের ছেলেটি

আশরাফ্‌ সিদ্দিকী

কবিকথাসাহিত্যিক, অগ্রণী লোকসাহিত্য বিশারদ, শিক্ষাবিদ . আশরাফ সিদ্দিকীর বহুল আলোচিত গল্পগলির ধারের ছেলেটিপোস্ট করলাম যারা পড়েননি, তাদের জন্য। যারা আগে পড়েছেন, তারাও আরেকবার চোখ বুলাতে পারেন। গত শতাব্দীর মধ্যভাগে রচিতগলির ধারের ছেলেটিবাংলা সাহিত্যের চিরায়ত এক ছোটগল্প। এই গল্পের চলচ্চিত্র রূপ : ‘ডুমুরের ফুল

#

সলিমুল্লা মুসলিম হল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই।

গেটের কাছে বের হলেই প্রতিদিন দেখি সেই ছেলেটিকে। দশ-এগারো বছর বয়স।

পরনে একটা শতছিন্ন ময়লা পেন্ট। গায়ে তালির উপর তালি দেওয়া একটা কালো ওয়েস্টকোট। খড়ি উঠা দেহ। উস্কোখুস্কো চুল। কতদিন তেল পড়েনি কে বলবে?

সেই চিরাচরিত একঘেয়ে নাকি কান্না :

‘একটি পয়সা সাহেব… সারাদিন না খেয়ে আছি। এক পয়সা দান করলে সত্তর পয়সা পাওয়া যায়।’…

পকেট হাতড়িয়ে পয়সা দিই কোনদিন, কোনদিন বকুনি লাগাই। বকুনি দিলেও বিপদ! পট করে নিচু হয়ে পায়ে এসে সালাম করে বসবে।নাছোড় বান্দা!

কিছুক্ষণ পরেই তাকে দেখবো মেডিকেল কলেজ গেটে। দু’পয়সার মুড়ি কাগজের ঠোঙ্গায় নিয়ে চিবোবে। চিরাচরিত নিয়মে পয়সা চাইবে।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হলেই গেটের কাছে আবার তার শ্রীমুখ! একটি পয়সা সাহেব!

উঃ জ্বালাতন! দুষ্টুমি করে মেয়েদের দেখিয়ে দিই। ছোট্ট টিনের মগটা ঠুন ঠুন আওয়াজ করে ছুটবে। পয়সা আদায় করে তারপর ছাড়বে। যিনি দেবেন না, চিরাচরিত প্রথায় নিচু হয়ে এক সালাম। একেবারে শক্তিশেল। ভ্যানিটি ব্যাগে হাত দেবেন তিনি। এমনি চলতে থাকবে কিছুদিন। এক মাস। তারপর হঠাৎ একদিন উধাও।

সেন্টার চেঞ্জ।

তাকে দেখবো সদর ঘাটে, ইসলামপুরের মোড়ে অথবা মিটফোর্ডের সম্মুখে। হয়তো সেখান থেকেও কিছু দিন পর উধাও।

আবার নতুন সেন্টার।

সাইক্লিক অর্ডারে ঘুরে এসে আবার সেই মুসলিম হল। মেডিকেল কলেজ। বিশ্ববিদ্যালয়।

: এই যে! -হিয়ার ইউ আর?

: এই, তোর দেশ কোথায়?

: ফরিদপুর।

: ভিক্ষে করিস কেন?

: ক্ষিদে পায় যে!

: থাকিস কোথায়?

: চকবাজার।

: কে আছে?

: কেউ নেই।

: কাজ করবি?

: ডানহাত অবশ যে!

: দেখি? -তাই ত!

চকবাজার থেকে মার্কেটিং করে ফিরছিলাম সাইকেলে। গলির মোড়ে এসে থমকে দাঁড়ালাম । তাই ত! সেই ছেলেটি তিনটি ইট বিছিয়ে ছেড়া কাগজ, টুকরো খড়ি এবং পাতা এনে সেই ইটের মধ্যে ভরে মাটির পাতিল চাপিয়ে রান্না করছে! ধূমা থেকে চোখ বাঁচাবার জন্য, চোখ বুজে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে বাঁকা হয়ে। টগবগ করে চাল ফুটছে ছোট্ট মাটির পাতিলে।

: এই তোর সংসার নাকি?

ও : জি হুজুর !

ভাবলাম জিজ্ঞেস করে বিপদে পড়লাম নাকি? এক্ষুণি হয়তো পয়সা চেয়ে বসবে। কিন্তু তা চাইলো না।

: যাস না যে ওদিকে?

: জ্বর সাহেব।

: কদিন?

: পাঁচদিন।

: খাস্ কি?

: এতোদিন যা ছিলো পকেটে।

: ফুরিয়ে গেলে?

: মরে থাকবো।

: কি নাম বললি?

: লাড়ু মিয়া।

থাক থাক! লাড়ু–তেই চলবে! মিয়ার আর দরকার হবে না।

দেখলাম লাড়ুর সংসার। একটি গোল কালভার্ট। জুতোর দোকানের অনেকগুলি ভাংগা কাঠের বাক্স রেখে দিয়েছে ছোট্ট গলির মোড়ে। তারই তিনটে সাজিয়ে লাড়ুর ঘর উঠেছে। দুই বাক্স দিয়ে দুই দিক বন্ধ। মাঝখান দিয়ে যাবার পথ। ভেতরটা অন্ধকার। একটা তেল চিটচিটে কাঁথা, জুতার বাক্স দিয়ে বালিশ হয়েছে। একটা ঝোল্না। সেই চির-চেনা টিনের মগ। একটা ভাঙা আয়না এবং ভাঙা চিরুণী। সংক্ষেপে লাড়ুর সংসার।

আপনি যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান অথবা রিকশায় কিংবা মোটরে পথ অতিক্রম করেন- তখন আপনার গতি থামিয়ে এমনি গলির মোড়ে যদি সকরুণ এবং সহানুভূতিশীল দৃষ্টি নিয়ে তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন আপনার মতই একদল জীব এমনি করে করে দিন কাটায়। এরা পথের কুকুরের কাছ থেকে খাবার ছিনিয়ে খায়, পথে আপনাকে বিরক্ত করে। এরা মানুষ নয়। এরা অভিশপ্ত আদমের সন্তান। কবে কোন্ দূর প্রভাতে বিবি হাওয়া আর আদম নিষিদ্ধ গন্ধম খেয়েছিলেন, তারই প্রায়শ্চিত্ত করে চলে এরা দিনের পর দিন! কিন্তু বলতে পারেন এই প্রায়শ্চিত্তের শেষ হবে কবে? যুগ-যুগ সঞ্চিত পুঞ্জীভূত বেদনার অশ্রু বাষ্পে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠেনি কি আল্লাহতালার আরশ কুরসি? নেমে আসবে না কি আল্লাহতালার বজ্র-ভীষণ অভিশাপের লেলিহান অগ্নি-শাসন!

এরপর লাড়ুকে অনেকদিন দেখিনি। গলির মোড়ে পড়ে রয়েছে কংক্রিটের কালভার্ট, কেরোসিন কাঠের বাক্স দুটি! তার ঝোলা, টিনের মগ, আয়না, চিরুণি সব।

সাইকেল থেকে নেবে জুতার দোকানীকে জিজ্ঞাসা করি। ‘

লাট-বেলাট, মন্ত্রী-হাকিম, কাশ্মির, হায়দরাবাদ, হিল্লি-দিল্লির খবর সকলে রাখে। কিন্তু গরিবের খবর কেউ রাখে না। হয়তো কুকুর বেড়ালের মতো কোথায় মরে পড়েছিলো, শহরের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য মুরদা-ফরাস ফেলে দিয়েছে।

কিন্তু না। লাড়ু মরেনি। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলাম অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে। চার নং ওয়ার্ডে গিয়ে চমকে দাঁড়ালাম।

: কিরে লাড়ু–! তুই এখানে?

: হ্যাঁ স্যার (লাড়ু– স্যার বলতে শিখেছে)।

: কবে এলি?

: এক মাস।

: কি হয়েছিল?

: জ্বর।

: তারপর?

: অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম পথের ধারে!

: তারপর?

: কে একজন ফেলে রেখে গেছে এখানে।

মনে মনে বললাম : লাড়ুর ভাগ্য ভালো! কারণ সবই ত জানি। দরিদ্রের টাকায় গড়ে ওঠে রাষ্ট্র। কিন্তু গরিবের কতটুকু অধিকার! বিরাট ম্যানসন- বিরাট-বিরাট হাসপাতাল গড়ে ওঠে- সমুখের দরজা থেকে হতাশ-চোখে ফিরে আসে গরিব- ‘ভাগো হিয়াসে! সিট নেই হ্যায়’…।

লাড়ুর ভাগ্য ভালো! তার সিট হয়েছে! দিব্যি আরামে আছে সে! দুধের মতো পরিষ্কার সাদা বিছানা। নরম বালিশ। পশমের কম্বল তার উপরে স্প্রিং-এর খাট! লাড়ু কি এর আগে এতো আরামে কোনদিন ছিল? লাল টুকটুক্ কম্বল গায়ে দিয়েছে? গায়ে হাসপাতালের স্ট্রাইফস-এর শার্ট। পরনে স্ট্রাইফস-এর পায়জামা।।

স্প্রিং-এর খাটের উপর বসে মাখন দিয়ে সে রুটি চিবোচ্ছিল। আর খাটের উপর বসে দুলছিল! লাড়– দিব্যি আছে! সকালে ডিম-রুটি, মাখন, চা, দুধ, দুপুরে ভাত-মাংস, দুধ কমলালেবু, বিকেলে মাখন-রুটি দুধ পুডিং…। বন্ধুকে দেখে লাড়ুর সিটের দিকে যাই। সে তখনো স্প্রিং-এর খাটের উপর জোরে জোরে দুলছে। হি হি করে হাসছে।

: কি রে কেমন আছিস?

: খুব ভালো।

: চলে যাবি কবে?

: কোনদিন যাবো না।

: তার মানে? এখানে চিরদিন তোকে থাকতে দেবে নাকি?

: না আমি যাবো না। লাড়ুর চোখেমুখে দৃঢ় প্রতিবাদের ভাব।

বন্ধুকে দেখতে আসি। লাড়ুর সিটের দিকে তাকাই। শিস দিয়ে দিয়ে সমস্ত ওয়ার্ডময় ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। একবার এ বিছানার পাশে, একবার ও বিছানার পাশে। ট্যাপ থেকে পানি ভরে দেয় কখনও কখনও কোন রোগীকে। গান করে গুন্ গুন্…

আবার নিজের বিছানায় বসে কিছুক্ষণ দুলে নেয়। এক টুকরো রুটি চিবোয়। চিনি ফুরিয়ে গেছে। পাশের রোগীর কাছ থেকে ধার নেয়। বিকেল বেলাতেই দিয়ে দেবে আবার। মাখন চেয়ে নেয় ডানদিকের বেড থেকে। নার্স এসে যায়। ঔষধ খাবার পালা। বিছানা থেকে নেবে একছুটে গিয়ে নার্সএর পায়ে এক আভূমিলম্বিত সালাম।

কিন্তু না, পয়সার জন্য নয় এবারে।

হা-হা করে হেসে ওঠে সকলে। দেখে দেখে অভ্যাস হয়ে গেছে সকলের!

: কি রে দুষ্টু কেমন আছিস? নার্স বলে।

অবশ হাতটা অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরিয়ে উত্তর দেয় ভালো আছি।

নার্সের পেছনে পেছনে সমস্ত ওয়ার্ডময় ঘুরে বেড়াবে, নার্সের ঔষধের প্লেট, থার্মোমিটার, পিউরিফাইয়ার এবং ইনজেকশনের ট্রলি বহন করে চলবে তার পেছনে পেছনে। সমস্ত ওয়ার্ড ঘোরা শেষ হবে। এইবার তার পালা।

: দিদি?

: কি?

: বুঝতে পারে সবই নার্স। তেতো ঔষধে তার অরুচি।

: আচ্ছা আজ নাক মুখ বুজে খেয়ে ফেল। কাল মিষ্টি ওষুধ দেবো।

: দিদি?

: কি

আবার করুণ চোখে আবেদন। বুঝতে পেরেছে নার্স।

: চকোলেট।

: আচ্ছা- নে আমার এই পকেট থেকে । হাত বন্ধ আমার।

চার চারটে চকোলেট পেয়ে লাড়ুর আনন্দের সীমা নেই। দোল দোল দোল্। ছড়া কাটে : দোল দোল দুলুনি, রাঙা মাথায় চিরুণি…দুলতে থাকে প্রিং-এর খাটে।

হাসপাতালের নার্স। কথাটি শুনেই আপনাদের কেমন লাগে, তাই না? যার কোন গতি নেই সেই নাকি হাসপাতালের নার্স হয়! জাত হারিয়ে নাকি বৈষ্ণব সাজে!

নার্স রোকেয়ার জীবনে এমন কোন ইতিহাস আছে কিনা জানি না, তবে এটা ঠিক দারিদ্র্য তাকে টেনে এনেছে এখানে। ঠিক লাড়ুর মতই দেখতে, তেমনি দুষ্টু একটা ভাই ছিল তার। তেরশ পঞ্চাশ, মন্বন্তর, যুদ্ধ-দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ব্যাংক, মার্কেট, অনেক কিছু ঘটে গেছে বাংলাদেশে। রোকেয়ার পিতামাতা- সব কিছু গেছে! অসুস্থ পিতার চিকিৎসার জন্য শেষ সম্বল তার কানের রিংটি দিয়ে দোকানে পাঠিয়েছিল ভাইটিকে- সেই যে গেল আর এলো না…লাড়ুর মুখের দিকে তাকিয়ে তার হারানো ভাইটির কথা মনে পড়ে। সে যেন তারই মত দেখতে ছিল- তারই বুঝি স্মৃতি বহন করে চলছে। সেই মুখ- সেই চোখ!

ছেলেটার প্রতি মনের অজান্তেই, কেমন মায়া পড়ে গেছে তার। কতো রোগী আসে- কতো রোগী চলে যায়। কতোজন এলো- কতোজন চলে গেল। সে-ও হয়তো চলে যাবে একদিন এবং খুব শিগগিরই!

: ইউ বেড নং ফোরটিন! দেখি টিকেট?

: লাড়ু–।

: ইয়েস। এল-এ-আর-ইউ লাড়ু– হাউস-ফিজিসিয়ান নাম লেখেন।

: তোকে চলে যেতে হবে, ভাল হয়ে গেছিস তুই।

বেদনায় ম্লান হয়ে ওঠে লাড়ুর মুখ। খাট থেকে নেমে চট করে পায়ে সালাম করে ফেলে সে হাউস-ফিজিসিয়ানের।পয়সার জন্য নয়! যাবে না সে এখান থেকে।-না- সে কিছুতেই যাবে না!!

: আচ্ছা বেশ। কাল না হয়, পরশুদিন চলে যাবি। ডাক্তার বলেন।

নার্স রোকেয়া আসে বিকেলে। ঘড়ির কাঁটায় কাটায়। পায়ে সালাম করে না লাড়ু–। চকোলেট চায় না। গম্ভীর হয়ে যায় সে। তারপর কেঁদে ফেলে ঝরঝর করে।

: দিদি। আমি যাবো না। যাবো না।

: কি পাগল ছেলে তুই, বলতো! তোকে চিরদিন কি এখানে থাকতে দেবে?

: না, আমি কিছুতেই যাবো না।

অশ্রুসজল হয় নার্সের চোখ। হারিয়ে যাওয়া ভাইটির করুণ স্মৃতি মনে পড়ে। কি অসহায়! পিতা নেই, মাতা নেই, আত্মীয়-বান্ধবহীন সংসারে বিপুল জন-সমুদ্রে খড়কুটোর মতো ভেসে চলে এরা।

দুইদিন পর হাউস-ফিজিসিয়ান আবার বলেন : তুই আজও যাসনি? কাল সক্কালে উঠে চলে যাবি।

রোকেয়া অনুনয়ের সুরে ফিসফিস করে ডাক্তারকে বলে, আর কটা দিন থাক। শরীরে এখনো নর্মাল ভিগার আসেনি।

: আচ্ছা বেশ-বেশ। থাকুক দিন কয়েক ।

সুপার আসেন কিছুদিন পরে। এ বেড থেকে ও বেড ঘুর ঘুর করে ঘুরে বেড়ায় লাড়ু–। শিস দিয়ে ছড়া বলে ও : এক শিয়ালে রাঁধে বাড়ে আর এক শিয়ালে খায়। রাজার বেটা জগন্নাথ ঘোড়ায় চড়ে যায়…। সিনেমার গান করে গুন গুন করে।

: হু ইজ দ্যাট বয়?

: পেসেন্ট। নার্স বলে।

: এই ছোকরা বেড ছেড়ে ওখানে ঘুরছিস কেন? বেড নং ফোরটিনের কাছে এসে টিকেট দেখে সুপার।

: ভালো হয়ে গেছে তবে রাখা হয়েছে কেন এতোদিন?

আমতা আমতা করেন হাউস-ফিজিসিয়ান আর নার্স।

ডিসচার্জ করে দেবেন কাল। সুপারের আদেশ।

: তোকে এ-ত-বা-র বলি বেড ছেড়ে ঘুরাঘুরি করবি না। দুষ্টুমি করবি না। এইবার হলো তো! কাল চলে যেতে হবে তোকে। নইলে চাকরি যাবে আমার।

ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে থাকে লাড়ু– : না-না আমি যাবো না! আমি কিছুতেই যাবো না!! না-না

: কি পাগল! ভালো মানুষকে কি এখানে থাকতে দেয় কখনো?

: ভলো মানুষ মানে? আমার অবশ হাত ভালো করে দাও!

: ওটা তো তোর জন্ম থেকে ! ওকি আর ভালো হয়?

সব ওকালতিই ফেল হয় লাড়ুর । সারাটি দুপুর গম্ভীর হয়ে শুয়ে থাকে সে! মনে মনে বুদ্ধি আঁটে।

হৈ চৈ পড়ে যায় বিকালে। ডাক্তার ছুটে আসে। নার্সরা আসে আইওডিন আর ব্যান্ডেজ নিয়ে। কাচে মারাত্মক ভাবে পা কেটে গেছে লাড়ুর। পা কেটে ভেতরের সাদা মাংস দেখা যাচ্ছে। রক্তে ভেসে যায় ওয়ার্ড। নিতে হয় অপারেশন এর জন্য।

ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় বিছানায় শুয়ে থাকে লাড়ু–। বিকেলে রোকেয়া আসে।

: কেমন করে কাটলি?

: কাচে।

বিছানায় উঠে বসে সে। নার্স রোকেয়াকে কাছে ডেকে নিয়ে আসে। অন্তরঙ্গভাবে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস্ করে বলে, ওরা তো বললো থাকতে দেবে না- তুইও বললি ভালো মানুষকে থাকতে দেবে না এখানে। দরজার কাছে সেই ভাঙগা কাচের টুকরোটা ছিল না- সেইটা দিয়ে উল্টো দিকে তাকিয়ে দিলাম পায়ে এক হ্যাচকা টান। ভেবেছিলাম একটু কাটবে- কিন্তু বড় বেশি কেটে গেলো যে দিদি! যা রক্ত পড়লো! এবারে বেশ নিশ্চিন্তে থাকা যাবে এখানে- তাই না দিদি? এখন ত আমি রোগী।

অশ্রুসজল হয় রোকেয়ার চোখ! টস্ টস্ করে গাল বেয়ে সে অশ্রু ঝরে পড়ে…

দীর্ঘ এক মাস পরে ঘা সারে তার। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়। আবার তাগিদ। কোন রোগীকেই এতদিন রাখার নিয়ম নেই। সুপারের কড়া হুকুম ।

: তুই এবারে চলে যা লাড়ু–!

রোকেয়া অশ্রুসজল চোখে বলে।

: না, না, না- আমি যাবো না! আমি কিছু-তে-ই যা-বো-না! লাড়ুর পুরাতন জবাব। ঔষধের প্লেটে ইনজেকশন, ফাইল ইত্যাদি নিয়ে রোকেয়ার পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়ায় সমস্ত ওয়ার্ড দিয়ে। তার কাছ থেকে চকোলেট নিয়ে সকলকে দেখিয়ে আরাম করে চুষতে থাকে।

: এটা কি ঔষধ রে দিদি?

: কুইনাইন মিকশ্চার?

: ওটা কি রে?

: টিনচার আইওডিন।

: এটা?

: বেলাডোনা।

লাড়ুর প্রশ্নের চোটে বিরক্ত হয়ে ওঠে রোকেয়া বলে, বড্ড বকিস তুই, থামতো!

: আচ্ছা দিদি! ফিসফিস করে কানে কানে বলে সে- এমন কোন ঔষধ নেই যেটা খেলে চিরদিন থাকা যাবে এখানে। শরীরটা বেশি ভালোও হবে না। বেশি খারাপও হবে না।

: উঃ বড্ড বিরক্ত করিস তুই। কান ঝালাপালা হয়ে গেলো!

রোগীদের ঔষধ আনতে আলমারির দিকে যায় রোকেয়া। রাশিকৃত বোতল। গায়ে লেবেল আঁটা।

: হেই সবুজ ঔষধটা কিসের রে দিবি?

: লাড়ুর প্রশ্ন বিরামহীন।

: ওটা দাঁতের।

: ওই লাল টুকটুকেটা?

: ওটা খেলে ক্ষিধে লাগে।

: আর এই ইটের রঙ-এরটা?..

টিনচার আইওডিনের শিশি দেখিয়ে প্রশ্ন করে লাড়ু–। রোকেয়া এবারে ভীষণ বিরক্ত হয়ে যায়।

: এটা? এটাএমন এক ঔষধ যা খেলে কোনদিন-কোনদিন তোকে এখান থেকে যেতে হবে না। একেবারে চিরদিনের জন্য থেকে যেতে হবে। ছোট্ট একটা ধমক দিয়ে ব্যস্তভাবে রোগীদের কাছে চলে যায় সে। একটি সিরিয়াস রোগী আছে…তার আজ অপারেশন-

লাড়ু একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখে বোতলটা। মাঝের তাকে তিনটে বোতলের পর সবচেয়ে বড় বোতল। মনে মনে মুখস্থ করে রাখে। মাঝের তাকে তিনটে বোতলের পর…

খাটের উপর বসে আবার দুলতে থাকে সে। সমস্ত ঘরময় টহল দিয়ে বেড়ায়। গান গায় গুন্ গুন্ করে। রাত্রি চারটে বাজে। সমস্ত হাসপাতাল নিস্তব্ধ-সবাই ঘুমুচ্ছে। কেউ জেগে নেই। নার্সরা ডিউটি শেষ করে চলে গেছে বিশ্রাম কক্ষে।

এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে আস্তে বিছানা ছাড়ে লাড়ু–। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় আলমারির দিকে। মাঝের তাকে তিনটে বোতলের পর…।

আলমারি খুলে বোতলটা ধীরে ধীরে বের করে নিজের বিছানায় মশারির নিচে গিয়ে ঢোকে। গরগর করে ঢেলে দেয় মুখে। কিন্তু একি! সমস্ত জিভ-মুখ যে পুড়ে যাচ্ছে আগুনের মতো। যেন নাড়ীভুড়ি ছিড়ে ঢুকছে ঔষধটা। তবে যে দিদি বলেছিলো…হাত থেকে খসে পড়ে যায় বোতল। কপাল ঘেমে ওঠে। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসে। আবছা স্বপ্ন দেখে তার মা যেন হাত বাড়িয়ে ডাকছে…।

সকাল বেলায় চার নং ওয়ার্ড ভরে গেলো ডাক্তার নার্সে। ওয়ার্ডের সমস্ত রোগীরা ঝুঁকে পড়লো চৌদ্দ নাম্বার বেডের সম্মুখে। সেই চঞ্চল ছেলেটা আইওডিন খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। সমস্ত শরীর, মুখ নীল হয়ে গেছে!

টসটস করে পানি গড়িয়ে পড়ে নার্স রোকেয়ার গাল বেয়ে। পাগলের মতো চিৎকার করে বলে : না-না-সে আত্মহত্যা করেনি। সে এখানে থাকতে চেয়েছিলো চিরদিনের জন্য থাকতে চেয়েছিল। -এ পৃথিবীতে তার কেউ ছিল না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে আসি। গলির ধারের সেই ভিক্ষুক ছেলেটি আর বিরক্ত করে না।

#