আলোচনা =
আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্প-ভুবন
আবু সাইদ কামাল
আলাউদ্দিন আল আজাদ ৬ মে, ১৯৩২ সালে রায়পুরা, নরসিংদীতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-মা’র পাঁচ সন্তানের মাঝে তিনিই একমাত্র ছেলে। বয়স যখন দেড় বছর তখন তাঁর মা মারা যান এবং দশ বছর বয়সে হারান বাবাকে। অভিভাবকহীন পরিবারের জমাজমি আত্মীয়-স্বজনেরা দখল করে নেয়। সে সময়েই আসে পঞ্চাশের মনন্তর। নবীন এই কিশোর বুঝতে পারলেন, শিক্ষাই হবে তার একমাত্র অস্ত্র। তখন থেকে গ্রন্থপাঠে এক রোমাঞ্চকর জগত আবিস্কারের সাথে সাথে তাঁর মেধা বিকশিত হতে থাকে। প্রত্যেক শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করতে থাকেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার পর বুঝতে পারেন, গ্রামে থেকে পড়াশোনা করলে তাঁর প্রত্যাশা পূরণ হবে না। ছোট্ট একটা টিনের সুটকেস নিয়ে ঢাকায় এসে ভর্তি হন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। প্রবেশিকায় প্রথম বিভাগ থাকায় কলেজে ফ্রি স্টুডেন্টশিপ পান এবং পেলেন ষোল টাকা মহসিন বৃত্তি। পড়াশোনার পাশাপাশি রাতে তিনি খবরের কাগজে খণ্ডকালীন কাজ করতেন। তাঁর দাদি বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ায় পণ করেছিলেন ডাক্তারি পড়বেন। কিন্তু ডাক্তারি পড়ার খরচ এবং এত সময় কোনোটাই তাঁর দেওয়া সম্ভব ছিল না। ওদিকে মাত্র সতের বছর বয়সে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘জেগে আছি’ প্রকাশিত হয়। সম্ভবত সাহিত্যপ্রীতির কারণেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ভর্তি হন। বাংলা অনার্স পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে বার বছর পর তিনি এই স্থান অধিকার করেন। ১৯৫৪ সালে এমএ করে তিনি সরকারি কলেজের অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত হন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ‘ঈশ্বরগুপ্তের জীবন ও কবিতা ’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পেশাগত জীবনে মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসে সংস্কৃতি উপদেষ্টা, শিক্ষা সচিব ছাড়াও সংস্কৃতিবিষয়ক বিভাগ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
মেধাবী শিক্ষার্থী ও জ্ঞানতাপস আলাউদ্দিন আল আজাদ ভাষা আন্দোলনসহ সমসাময়িক কালে সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন। তাঁর প্রথম সাহিত্যিক রচনা ‘আবেগ’ মাসিক সওগাতে ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত হয়। প্রথম গল্প ‘জানোয়ার’। মাত্র তের বছর বয়সে রচিত হলেও ‘আবেগ’ ও ‘জানোয়ার’ পরিণত সাহিত্য । যাঁরা তাঁর লেখা ছেপেছিলেন, তাঁরা ভেবেছিলেন, আজাদ প্রবীণ ব্যক্তি। কিন্তু দেখার পর তাঁরা আলাউদ্দিন আল আজাদকে বলতেন অলৌকিক প্রতিভাধর। প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ১২০টি। তাঁর রচিত উপন্যাস ‘কর্ণফুলি’ বাংলাভাষায় একমাত্র গ্রন্থ যা ১৯৬৩ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার পায়। বুলগেরিয় ভাষায় অনূদিত তাঁর ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ পকেট বই হিসাবে অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বাংলা ভাষার আর কোনো গ্রন্থ এত মর্যাদা পায়নি। বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত তাঁর গল্প ‘বৃষ্টি’ এবং তাঁর কবিতাগুচ্ছের অনুবাদ বিশ্বসাহিত্যের নন্দিত রচনাবলী। তাঁর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘সূর্যস্নান’ এবং ‘বসুন্ধরা’। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ইউনেস্কোর পুরস্কার এবং একুশে পদকসহ সতেরটি সাহিত্য পুরস্কারে লাভ করেন।
সমাজ সচেতন সাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদ সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। কথাসাহিত্যে তাঁর অবদান গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। বরেণ্য এ লেখকের প্রথমদিকের গল্পে শ্রেণিসংগ্রাম বিশেষভাবে রূপায়িত হওয়ায় ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। বলা যায়, জীবনমুখীনতা তাঁর গল্পের বৈশিষ্ট্য। মানুষের জীবন সংগ্রাম এসব গল্পে বিধৃত হয়েছে। তাঁর কোনো কোনো গল্পে যেমন সমাজজীবনের বাস্তব ও অন্তরঙ্গ পরিচয় ফুটে উঠেছে, তেমনি কিছু কিছু গল্পে ফ্রয়েডীয় রীতিবৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। বলা যায়, বিচিত্র স্বাদের বেশ উৎকৃষ্টমানের গল্প তিনি রচনা করেছেন।
উপনিবেশ-উত্তর কাল থেকে নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্ত সমাজের নাগরিক বিকাশের সাথে সাথে জীবনের নানাবিধ জটিলতা লেখকদেরও সচেতন করেছিল। চল্লিশের দশকে আমরা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং শওকত ওসমানের মতো উঁচুমানের কথাসাহিত্যিককে পাই। বাংলা ছোটগল্পের সেই ধারাতেই এদেশে পঞ্চাশের দশকে গল্পকারদের উত্থান দেখি। এই দশকের শক্তিশালী গল্পকার আলাউদ্দিন আল আজাদ। বাংলা কথাসাহিত্যের বাস্তবতা, নিবিড় বিষয়-বৈচিত্র্যের বাইরে আলাউদ্দিন আল আজাদের শিল্পচেতনার যে অতিরিক্ত বিশেষত্ব চিহ্নিহ হয়, এর পরিচয় পাওয়ায় যায় তাঁর গল্পভাষার কাব্যময়তায়, বর্ণনার শিল্পীত মাধুর্যে ও বাক্যবিন্যাসের চমৎকারিত্বে। এসবের সমন্বয়ে গড়ে উঠে তাঁর রচনার অনন্য এক শিল্পশৈলী।
আলাউদ্দিন আল আজাদ রচিত ছোটগল্পগ্রন্থ : ১. জেগে আছি, ২. ধানকন্যা, ৩.মৃগনাভি, ৪. অন্ধকার সিঁড়ি, ৫. উজান তরঙ্গে,৬. যখন সৈকত, ৭. আমার রক্ত স্বপ্ন আমার, ৮. জীবনজমিন, ৯. নির্বাচিত গল্প, ১০. মনোনীত গল্প, ১১. শ্রেষ্ঠ গল্প ইত্যাদি।
গল্পের উপজীব্য বিষয় বা উপকরণ সংগ্রহের জন্য তিনি গ্রাম-জীবনের নানা প্রান্তে বিচরণ করেছেন। চরিত্র সৃষ্টিতে কোনোরূপ আরোপিত বৈশিষ্ট্যের অন্বেষী হন নি। ফলে তাঁর ‘জেগে আছি’, ‘ধানকন্যা’ গল্পগ্রন্থদ্বয়ে সূচিবদ্ধ গল্পগুলোতে সমাজের বাস্তব ও অন্তরঙ্গ চিত্র ফুটে উঠেছে। এসব রচনায় উপজীব্য বিষয় ও চিত্রের সাথে লেখকের গভীর পরিচয় ও নিবিড় সম্পর্ক আন্তরিকতায় অভিব্যক্ত। গ্রাম-জীবনের পটভূমিকায় তিনি যেমন সংগ্রামী মানুষের পরিচয় তুলে ধরেছেন, তেমনি শহুরে পটভূমিতেও নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নশ্রেণির সংগ্রামী মানুষের পরিচয় ফুটে উঠেছে।
সমাজের অর্থনৈতিক শোষণ-পীড়ন-লাঞ্ছনা, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, মৌলিক চাহিদার বঞ্চনা-শিক্ষা সমস্যা ইত্যাদি তাঁর গল্পে চমৎকারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এ সম্পর্কে তাঁর নিজের অভিব্যক্তি তুলে ধরা যায়:
‘ছোটবেলা থেকেই আমার জীবন ও সাহিত্য অবিচ্ছেদ্য। সতের বছর বয়সে প্রকাশিত আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘জেগে আছি’র গল্পগুলোতে যে শ্রেণিযুদ্ধের প্রতিচ্ছবি তারও একই কারণ, আমার সাহিত্য, আমার অভিজ্ঞতা ও আত্মচরিত।’
মাত্র সতের বয়সে ‘জেগে আছ’ (জানুয়ারি, ১৯৫০) গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে গল্পকার হিসাবে তাঁর সোচ্চার আত্মপ্রকাশ ঘটে, উভয় বাংলার সুধীসমাজকে তিনি চমকে দেওয়ার মতো সক্ষমতা অর্জন করেন। তখন ওপার বাংলার সত্যযুগ পত্রিকার গ্রন্থ পরিচয় বিভাগে শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেন, বিনা দ্বিধায় শিকার করতে পারি, ‘জেগে আছি’ সাম্প্রতিক মুসলিম সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ এবং সমগ্রভাবে বাংলাসাহিত্যের সেরা বই (সত্যযুগ, রবিবার, ১২ জুন, ১৯৫০)।
প্রথম ছোটগল্প গ্রন্থেই লেখকের স্বকীয়তার বৈশিষ্ট্য সহজেই লক্ষণীয়। এতে মোট সাতটি গল্প সংকলিত হয়। গল্পগুলো হলো : একটি সভ্যতা, শিকড়, মহামুহূর্ত, অসমাপ্ত, সৃষ্টি, মোচড় ও একটি কথার জন্ম।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাহিত্যপত্র ‘মুক্তি’র আলোচনায় এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করা হয়, এখান থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু। কিছুদিন পর মাহবুবুল আলম এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘তাঁর ধানকন্যা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। মনে হয়েছে এ এক নতুন জ্যোতিষ্ক সমগ্র গগনে যাকে পথ ছেড়ে দিতে হবে। এমন স্বচ্ছ ও সুন্দর প্রকাশভঙ্গি কোন লেখকেরই নয়। ঊষার শুভ্রতা তাঁর দৃষ্টিতে, উদীয়মান সূর্যের লালিমায় কী প্রচণ্ড শক্তির পূর্বাভাস অথচ কী অদ্ভূত সংযম (২০ ডিসেম্বর,১৯৫৩, দৈনিক আজাদ)।
গল্পের ভুবনে তাঁর এই অসাধারণ যাত্রার প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের সার্থকতা পরবর্তী গল্পধারায় অপূর্ব রূপ-রসে, শিল্প-সুষমায় ব্যাপক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে ‘বাংলাসাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে বলা হয়, ‘আলাউদ্দিন আল আজাদ দেশকাল ও সমাজসচেতন ছোট গল্পকার। শ্রেণীসংগ্রাম ও সংগ্রামের পরই সাফল্য এই নীতিতে স্থিরবিশ্বাসী আজাদকে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তাঁর প্রথম পর্বের রচনাগুলিতে। এ পর্যায়ের গল্পগুলির বিষয়বস্তু অনেকক্ষেত্রে গ্রামীণ। …মার্কসবাদী লেখক হিসাবে তাঁর গল্পের মধ্যে শ্রেণী সংঘর্ষের নির্মম পরিণতি প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে আজাদ ফ্রয়েডীয় রীতিতে বিশ্বাসী হয়েছেন। বস্তুত মার্কসবাদী বাস্তবতা এবং আজন্ম রোমান্টিকতা তাঁকে দ্বণ্দ্ব-ক্ষত করেছে…, মূলত আজাদ রোমন্টিক। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অনেকাংশে তাঁর কাছে রোমান্টিক সাম্যবাদে পর্যবসিত হয়েছিল। এই দ্বন্দ্বের কার্যকারণ যেমন তাঁকে শিল্পসমৃদ্ধ করেছে, তেমনি তাঁকে এক পর্যায়ে করেছে গভীর বিশ্বাস থেকে উৎকেন্দ্রিক।’
আলাউদ্দিন আল আজাদের সাহিত্যকর্মে জীবনের বাস্তব প্রতিফলন ছাড়াও এদেশের মাটির কাছাকাছি মানুষের হাসিকান্না ও বেদনার পরিচয় ফুটে উঠেছে। তিনি অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা সম্পর্কিত যেসব গল্প লিখেছেন সেগুলোর মধ্যে ‘একটি সভ্যতা’ অন্যতম। মোদ্দাকথা শ্রমিকদের নিয়ে গল্প লেখার ক্ষেত্রে আলাউদ্দিন আল আজাদ অগ্রগণ্য। এ সম্পর্কে বসির আল হেলাল তাঁর ‘বাংলাদেশের ছোটগল্প’ নামক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন: ‘তিনি আমাদের ছোটগল্পে অন্তত এই দিক থেকে পথিকৃৎ যে তিনিই প্রথম শ্রমিক-জীবনের আলেখ্য উপহার দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, শ্রেণীসংগ্রাম ও প্রলেতারিয়েতের শ্রেণীচেতনা তাঁর গল্পে মূর্ত হয়েছে।’
‘বৃষ্টি’ আলাউদ্দিন আল আজাদের বহুল পরিচিত একটি গল্প। মানুষের মনের বিচিত্র রহস্য উন্মোচনের সাথে সাথে সমাজের স্বরূপটিও উদঘাটিত হয়েছে এ গল্পে। এ সমাজে অসহায় নারী বিচারের মুখোমুখি হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাকেই বেশি নাজেহাল হতে হয়। গ্রামের মৌলানা বৃষ্টি না হওয়ার কারণ হিসাবে বাতাসীর অবৈধ গর্ভকে দায়ী করে। সাত-আট মাস আগে স্বামী মারা গেছে। থাকে মামাতো ভাইয়ের আশ্রয়ে। গ্রাম্য বিচারে বাতাসী আর তার মামাতো ভাই রহিমদ্দি দোষী সাব্যস্ত হয়। হাজী কলিমুল্লাহ বিচারের রায় সমর্থন করে। আবার হাজী কলিমুল্লাহ ষাট বছর বয়সে একুশ-বাইশ বছরের মেয়েকে বিয়ে করে তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে ঘরে তুলেছে। স্ত্রীকে সবসময় কাছে রাখে। ছোট স্ত্রীকে বাপের বাড়ি থেকে আনার জন্য প্রথমপক্ষের ছেলে খালেদকে পাঠায়। খালেদ আর ছোট মা সমবয়সী। চাঁদনি রাতে বাড়ি ফেরার সময় খালেদের সঙ্গসুখ জোহরার কাছে মহার্ঘ মনে হয়। স্বামীর বাড়ি ফেরার সময় অতৃপ্ত জোহরার পরমাকাঙ্খিত বৃষ্টি হয়। সে রাতে অসহায় বাতাসী আর রহিমদ্দিকে সালিশে দোষী সাব্যস্ত করে পঞ্চাশ ঘা জুতার বাড়ি দিয়ে কলিমুল্লাহ যখন বাড়ি ফিরে তখন ছোট স্ত্রী জোহরা জীবনের পরমাকাঙ্খিত সুধাপানে মত্ত। তখন প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। কলিমুল্লাহ বলে, আল্লাহর রহস্য। তখন তৃপ্ত জোহরা বৃষ্টিতে ভিজছে আর বলছে, বছরের পয়লা বৃষ্টিতে ভিজলে খুব ভালো। এতে যে ফসল ফলবে…’
অসাধারণ এ গল্পে নরনারীর যৌনতাকে প্রতীকীভাবে দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করেছেন লেখক।
আলউদ্দিন আল আজাদের গল্পের প্লট নির্মিত হয় নিম্নবর্গের মানুষের পাওয়া না পাওয়া, ভঙ্গুর অর্থনীতি, সমাজনীতিকে অবলম্বন করে। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্পে চরিত্রেরা নানা টানাপোড়েন, দুর্দশাগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত জীবনকে সম্বল করে দিন কাটায়।
আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্পে দেখা যায়, নিম্নবর্গের মানুষের চরিত্রগুলো কখনো মহাজন, কখনো জমিদার এবং মোড়লসহ অন্যান্য ক্ষমতাবান উচ্চবর্গ, কখনো অস্ত্রহাতে পাকসেনাদের দ্বারা শোষিত, নির্যাতিত। বিনাদোষে কখনো তাদের ভোগ করতে হয় সমাজের চাপানো নির্মম অত্যাচার, কখনো হতে হয় সমাজচ্যুত। অনটনের হাহাকার কখনো তাদের চারপাশের পরিবেশকে ভারী করে তোলে।
‘সুন্দর’এরকম একটি গল্প। এ গল্পে দেখা যায়, সুন্দরীর বাপ জাত কৃষক। প্রান্তিক কৃষক হওয়ার কারণে তাকে হতে হয় নায়েবের শোষণের শিকার। শিলাবৃষ্টিতে জমির ফসল বিনষ্ট হওয়ায় ইচ্ছে থাকলেও খাজনা দিতে পারে না। হাল সনের খাজনা দিয়ে মুক্তি নেওয়ার জন্য আবেদনও করেছিল। কিন্তু সুন্দরীর বাপের আবেদনের কোনো মূল্য দেওয়া হয়নি। বরং বকেয়া খাজনা পরিশোধ না করার অপরাধে কাছারি থেকে পাইক-পেয়াদা এসে ঢোল পিটিয়ে জমি নিলামে তুলে। সুন্দরীর বাপ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হলে হারাতে হয় তার জীবন।
‘কয়লা কুড়ানো দল’ গল্পে মনু, লালু, সোনাভান, রূপভান, গেদুর টোকাই জীবন চিত্রণে লেখক দক্ষ শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন। ওরা রেলস্টেশন থেকে কয়লা কুড়িয়ে অর্থ উপার্জন করে, পরিবার চালায়। লালুকে রোজ কয়লা বিক্রি করে আড়ং থেকে চাল, শুঁটকি, ও মিঠে আলু কিনতে হয়, নইলে হজম করতে হয় বাপের গালাগাল। মনু কয়লা কুড়িয়ে টাকা যোগাড় করতে পারলেই কেবল তার স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয়। তাই সে আশায় কয়লা কুড়ায়।
স্কুলে যাবার স্বপ্ন হয়তো তার কোনোদিন পূরণ হবে না, তবু সেই আশায় মনু কয়লা কুড়িয়েই যায়। কিন্তু মনুরা ভালোভাবে কয়লা কুড়াতে পারে না। আসে বাঁধা। স্টেশন মাস্টার ওদের সহ্য করতে পারে না। বরং ওদের ওপর চালায় নিপীড়ন।
‘শিষ ফোটার গান’ গল্পের আব্দুল মজিদ একজন বর্গাচাষী। তার মতো এমন আরও কবিতপয় লোকের বর্গাচাষী সনদ সংগ্রহ করতে বেশ হয়রানির শিকার হতে হয়। স্বীকার করতে হয় নানা রকম ত্যাগ। মজিদ জমি বর্গা নেওয়ার জন্য ছয়মাস না খেয়ে যে টাকা সঞ্চয় করে তাসহ পুত্রবধূর জন্য মায়ের রেখে যাওয়া ‘জেওর’ বিক্রি করতে হয়। মজিদ ছাড়া অন্য বর্গাচাষীদের কেউ বিক্রি করেছে ঘরের টিনের চাল, কেউ বা বিক্রি করেছে গাছ; কেউ বা চড়াসুদে টাকা ঋণ করেছে। এত কিছুর পরও ওরা জমিতে যে ধান পায়, তার অর্ধেক দিতে হয় জমির মালিককে। মজিদ স্বপ্ন দেখে, ধান কেটে স্ত্রীকে আবার জেওর কিনে দেবে। এ ক্ষেত্রে গল্প থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যায়: ‘ ধান উটলেই তোমার জেরর বানাইয়া দিয়াম। তোমার গা ছুঁইয়া কইতাছি।’ যদিও শেষ পর্যন্ত আব্দুল মজিদের স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা তা প্রশ্নবিদ্ধ রয়ে যায়।
‘ধানকন্যা’ গল্পে দেখা যায় শেখ ফরিদ খাজনা দিতে পারে না বলে তার জমি নিলামে উঠে। আগের দুই বছর ভালো ফসল ফলেনি বলে খাজনা দিতে পারেনি। তবে সুযোগ এলে দিয়ে দেবে বলে দেওয়ান সাহেবের সাথে চুক্তি করলেও সে চুক্তির কোনো মূল্য দেওয়া হয়নি। বরং দেওয়ান সাহেব প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে শেখ ফরিদের জমি নিলামে তোলে। ফলে হারাতে হয় তার জমি এবং কাজলী গাভী।
আলাউদ্দিন আল আজাদ কোনো কোনো গল্পে সমাজের শ্রেণীগত বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেছেন। ‘সমতল’ নামের গল্পে শ্রেণীগত ধারণা স্পষ্ট হয়। নিম্নবিত্ত শহুরে জীবনের নানা রকম বিড়ম্বনা এ গল্পের উপজীব্য বিষয়। জীবনের একই সমতলে বসবাস রশীদ, করিম, গফুর, সালাম এবং জমিরের। এরা পরস্পরের কাছে কোনো না কোনোভাবে ঋণী। ঋণ শোধ করতে না পায়ায় ওরা নানা রকম ছল-চাতুরির আশ্রয় নেয়। কারোর মাঝে শুভবোধ এলেও স্ত্রী’র বাধা বা নানা সীমাবদ্ধতার কারণে শুভবোধের পরিচয় দিতে পারে না। ফলে ওরা পরস্পর এমন একটা বাঁধনে আটকে যায়, যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এদেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের রূঢ় বাস্তব চিত্র এভাবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
‘ধোয়া’ নামক গল্পে কুলির মেয়ে কালীর জীবনের বঞ্চনার চিত্র অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কালীর সাথে আদিরসের খেলায় মত্ত হয় তথাকথিত ভদ্র সমাজের আবেদ। তাতে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে কালী। এ ঘটনায় নিজের সামাজিক মর্জাদার কথা চিন্তা করে কালীকে মারতে চায় আবেদ। তখন কালী প্রতিবাদী হয়ে বলে, মুকে কেনে মারবি সায়েব? মোর পেটে তো তোর লেড়কা আছে, সে কুলি হইব তাকে মারিস না।’ এখানে জীবনের চরম সত্যকে উন্মোচিত করে কালী। ভদ্র সমাজের কপটতার পর্দা সরিয়ে কালী এখানে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়।
‘কবি’ নামক গল্পে সম্যাবাদের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। আবু মহসিন একজন কবি এবং প্রেমিক। প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেলে একজন কবির মানসিকতা নিয়ে বিরহ-বিচ্ছেদ মেনে নেয়। কবি তার হৃদয়োচ্ছ্বাসের স্ফুরণ ঘটানো কিছু বেদনার কবিতা নিয়ে প্রকাশকের কাছে যায়। কবিতার কোনো বাজার নেই বলে প্রকাশক তাকে ফিরিয়ে দেয়। সে তখন খবরের কাগজের হকার বনে যায়। মুয়াজ্জিনের স্ত্রী’র সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এই প্রেম এবং কবিতা তার জীবনে কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। সে বরং হকার সমিতি গঠন করে শ্রমিক আন্দোলনে অংশ নেয়। সূক্ষ্ণভাবে কৌশলে লেখক এ গল্পে সাম্যবাদের কথা বলেছেন।
মৃগনাভি গল্পগ্রন্থের ‘ছাতা’নামক গল্পে মধ্যবিত্ত সমাজে পিতৃত্বের স্বরূপ ফুটে উঠেছে। একটি ছাতাকে রূপক হিসাবে সংসারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সংসারে স্বামী ছাতার মতো বিরাট একটা ছায়া দেয়। বিপদাপদ থেকে রক্ষা করে। ‘কাজে কর্মে বসতে শুতে তার কেবলি মনে হয় সংসার-ধর্মে স্বামী একটা ছাতা বিশেষ, যে সুদিনে দুর্দিনে ছেলেপুলে বৌকে ছায়া প্রদান করে, ঝড়বৃষ্টি রোদের হাত থেকে বাঁচায়।’ তাই রোকেয়া ছেলের স্কুলে যাওয়ার চেয়ে স্বামীর অফিসে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বেশি মনে করে। রোকেয়া যখন দেখে ছাতাটি পুত্রস্নেহের আধিক্যে ছেলেরই বেশি কাজে লেগেছে, স্বামীর তেমন কাজে আসেনি; তখনি সে আর্তনাদ করে উঠে। সে মনে করে, সংসারের জন্য স্বামীই ছাতা ব্যবহার করবে। মধ্যবিত্তজীবনের দুর্দশা, সন্তানের প্রতি পিতার বাৎসল্য, সংসারের জন্য স্ত্রী’র উৎকণ্ঠা গল্পটিতে শিল্পরসে সমৃদ্ধ করেছে।
‘পরী’ নামক গল্পে অসম বয়সের নর-নারীর মাঝে যৌন সম্পর্কের আলোকপাত করা হয়েছে। বৃদ্ধ ধনুমোল্লা নাতনির বয়সী কাজের মেয়ে পরীকে প্রয়াত স্ত্রী’র পাঁচ ভরি ওজনের হার দিয়ে মন রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু অথর্ব ধনুমোল্লার ব্যর্থতার জন্য পরী তাকে ‘বুইড়া’ বলে চলে যায়। বার্ধক্যজনিত কারণে যৌবন হারানো মানুষ কিভাবে বিড়ম্বনার শিকার হয়-এ গল্পে তার যথার্থ চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।
‘জমাখরচ’ গল্পে চা বাগানের শ্রমিকদের উচ্ছৃঙ্খল জীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে। লেখকের গতিশীল বর্ণনায় চা বাগানের শ্রমিক নর-নারীর জীবন চিত্র ফুটে উঠেছে।
‘বাঘিনী’ গল্পে বনের হিংস্র পশুর প্রতি মানুষের আপত্য¯স্নেহের বিষয় উঠে এসেছে। পশু ও মানুষের হৃদ্যতার চিত্র ফুটে উঠেছে এ গল্পে। তবে গল্পে দেখানে হয়েছে, বনের পশুকে বশ মানাতে পারলেও যুবতী স্ত্রীকে পোষ মানানো সম্ভব হয়নি।
এছাড়াও অর্থনৈতিক টানাপড়েন, শোষণ, ধনিক বা প্রভাবশালীর নির্যাতনের পরিচয় মেলে কাঠের নকশা, সৃষ্টি, মুখোমুখি, রোগমুক্তির ইতিবৃত্ত প্রভৃতি গল্পে।
‘যখন সৈকত’ গল্পটিতে সুন্দরী যুবতী মর্জিনা তার ক্যান্সারাক্রান্ত স্বামীকে অসীম ধৈর্য ও সাধনায় সুস্থ করে তুলে। কিন্তু স্বামী মর্জিনাকে সন্দেহ করে। স্বামী মনে করে স্ত্রী তার দেহকে পর পুরুষের ভোগের সামগ্রী করার সুযোগ দেয়। তাই স্বামীর সর্বনাশা সিদ্ধান্ত, স্ত্রীকে খুন করবে। ওদিকে স্বামীর হাতে খুন হতে মর্জিনার আপত্তি নেই। তার আগে অসীম সাধনায় স্বামীর সংসার রক্ষা করার গল্প শোনায়। তারপর মর্জিনা সাগরে ঝাঁপ দেয়। স্বামীও সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু ওরা বেঁচে উঠে এবং নতুন করে বাঁচার প্রেরণা পায়। এভাবে গল্পটিতে লেখক অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
‘অন্ধকার সিঁড়ি’নামক গল্পে সামাজিক অনাচারের চিত্র ফুটে উঠেছে। গল্পে রিকশা চালককে ভাড়া না দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে যায় দলিল। তাতে রিকশা চালক খানিক চেঁচামেচি করে। ফিরে এসে দলিল রিকশা চালককে ধমকায়। যে ধমক খাওয়ার কথা ছিল দলিলের, উল্টো সে ধমক দেয় রিকশা চালককে। রিকশা দাঁড় করিয়ে দেরি করে ভাড়া দেওয়ার জন্য যেখানে কৈফিয়ত দেওয়ার কথা ছিল যাত্রী দলিলের, উল্টো রিকশা চালককে কৈফিয়ত দিতে হয়। সমাজে এভাবে সুবিধাবঞ্চিতদের অহরহ বঞ্চনার শিকার হতে হয়। এ চিত্র সমাজের প্রায় সর্বত্র। গল্পকার দক্ষতার সাথে চিরকালীন সেই চিত্র তুলে ধরেছেন।
‘টেকনাফ’ গল্পে দেখা যায়, কোরবান মাঝির নৌকাই বাড়ি, নৌকাই ঘর। তার স্বপ্ন ছিল স্ত্রী ময়নাকে রানির মতো সাজিয়ে রাখবে। কিন্তু নিরন্তর আর্থিক দৈন্যদশার কারণে তা আর কখনো সম্ভব হয়নি। পেটের দায়ে বিক্রি করতে হয়েছে স্ত্রী ময়নার ‘চান্দির চেইন ও চান্দির বিছা’। এর পর আর বানিয়ে দিতে পারেনি জেওর। বাজারে বড় বড় দোকানঘর ভর্তি শাড়ি কাপড়, ওড়না, কামিজ। কাঁচের ভিতরে রাখা মিষ্টি। রাস্তার দু’দিকে সজ্জিত দালান বা ইমারতের পাশে নিজেকে যেনো লোম ওঠা কুকুরের মতো মূল্যহীন মনে হয়। এভাবে সামাজিক বৈষম্যের নিখুঁত চিত্র নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পকার।
আলাউদ্দিন আল আজাদের বেশ কিছু গল্প মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বন করে রচিত। ‘দূরযাত্রা’ নামের গল্পে দেখা যায় মান্নান নিম্নবিত্তের এক লোক মুক্তিযুদ্ধকালের ডামাডোলে এক পর্যায়ে ক্ষমতাবান হয়ে উঠে। মান্নান এক সময়ে ছিল প্রান্তিক পর্যায়ের বিড়ি ব্যবসায়ী। যুদ্ধের সময় লুটপাটে অংশ নিয়ে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়। স্বাধীনতার পর ক্রমে সে ভৈরবে ভাড়া করে গোদাম ঘর রেখেছে, নরসিংদীতে পেতেছে গদী। মান্না থেকে হয়ে উঠেছে মান্নান সাহেব। অর্থের দাপটে ক্ষমতাবান হয়ে অন্যের ঘরের বউয়ের প্রতি কুনজর দেয়। সেই প্রয়াসে নুরবানুর সাথে ফষ্টিনষ্টি করে।
সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাদের কাছে সাধারণ মানুষের অকথ্য নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠে ‘নীরবতা’গল্পে। গল্পটিতে মেঘা এবং বাতাসী গরীব নারী। ওদের ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। বাতাসীর ওপর চালানো হয় বর্বর যৌন নির্যাতন। বাঁচবার কোনো উপায় না থাকায় বাতাসী ও তুফানী বাধ্য হয়ে দেহদান করে হানাদারদের। ‘নাকফুল’গল্পে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা ধর্ষিতা ফুলজান পরে সমাজে থেকে হয় বঞ্চিত। সমাজের চোখে হয় সে ঘৃণ্য, জীবনের কাছে হয় লাঞ্ছিত। সমাজ তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে বাধা দেয়।
‘স্মৃতি তোমাকে ভুলব না’ গল্পে মুক্তিযুদ্ধের রূঢ়বাস্ততার করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণের শিকার হয়। একাত্তরের ষোল ডিসেম্বরের পর পাক সেনারা দেশ ছাড়লেও রেখে যায় তাদের পাশবিকতার স্বাক্ষর। স্মৃতির পেটে বয়ে চলতে হয় ধর্ষণের কলঙ্ক। তাকে পেতে হয় কলঙ্কিণী খেতাব। সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে সমাজ সেই সন্তানকে বাঁচতে দেয়নি, মেরে ফেলেছে। কিন্তু তার দেহে রয়ে যায় তার প্রভাব। সন্তানকে দুধ খাওয়াতে না পারায় যন্ত্রণাকাতর হয়ে বলে, আমার বাচ্চারে মাইরা ফেলাইছে। …কিন্তু আমার দুধ তো ঠিকই আছে। জমা হয়। ফুইল্লাফুইল্লা উডে। আমি ছাটফট করি। মনে লয়, ছুরি দা কাডি। সব বাইর কইরা দেই।’
‘সংক্ষিপ্ত’ গল্পে পাকিস্তানি সেনাদের নির্মম অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞের শিকার এক যুবক। কবর তো দূরে থাক, মাটিচাপা পাওয়ার অধিকারটুকুও সে পায় না। শেয়াল-কুকুরে খায় তার লাশ। আলী, কাজল লাশটি আনতে গিয়ে দেখতে পায়, একপাল শিয়াল মচ্ছব করে লাশের মাংস ভক্ষণ করছে। এভাবেই মুক্তযুদ্ধকালের নিখুঁত চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাঁর গল্পে।
‘আঁতুরঘর’ গল্পে মানুষের ভেতরের সত্তাকে দেখার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। আমাদের সমাজের কিছু মানুষ পশু তথা কুকুরকেও মানুষের চেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়। তেমনি সমাজিক অসঙ্গতির একটি চিত্র তুলে ধার হয়েছে গল্পে। এ গল্পে অন্ধ সলিমদ্দি এক পথের ভিখারি। ঝড়-বৃষ্টির মাঝে সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে এক বাড়ির কুকুরের ঘরে গিয়ে উঠে। সে কক্ষেই সন্তান প্রসব করে তার স্ত্রী। বিপত্তি দেখা দেয় যখন ছেলে হওয়ার সংবাদ শুনে অন্ধ ভিক্ষুক আজান দেয়, তখন বাড়ির সব কাজের লোক-দারোয়ান-ড্রাইভার এবং বাসার মালিক পক্ষও ছুটে আসে। এ দৃশ্য মালিক ভালো চোখে দেখেনি। সে বলে, যত্তোসব রাবিশ, শুয়োরের বাচ্চারা বিয়োবার আর জায়গা পায় না।’এ সমাজের মানুষের এমন অমানবিক আচরণের সমাজচিত্র শিল্পরসে সার্থক করে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পকার।
আত্মোপলব্ধির শ্রেষ্ঠ উপায় হলো সাহিত্য। তার মাঝে গল্পসাহিত্যের ভূমিকাই প্রধান। বাংলা কথাসাহিত্যের সামগ্রিক বিবেচনায় আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্পের ভুবনে শিল্পচেতনার যে বিশেষত্ব ধরা পড়ে তা হচ্ছে, ভাষার শিল্পমাধুর্য, বাক্যগঠনের অভিনবত্ব এবং গল্পে প্রতীকধর্মী চিত্রকল্পের সার্থক ব্যবহার। তাঁর গল্পে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ যেমন কথা বলে, তেমনি জীবনের বিভিন্ন দিক উপস্থাপিত হয় গল্পের ক্যানভাসে। এ জন্যই তাঁর গল্প মানুষের জীবনের কথা বলে, দেশ ও জাতির কথা বলে। বাংলাসাহিত্যের ছোটগল্পে তিনি অনন্য সৃষ্টিশীল এক করিগর।
তথ্যসূত্র :
১.বাংলাদেশের সাহিত্য-মাহবুবুল আলম
২.শ্রেষ্ঠ গল্প-আলাউদ্দিন আল আজাদ
৩. আলাউদ্দিন আল আজাদের ছোটগল্প: বিষয় ও প্রকরণ- তবিবুর রহমান।
৪.আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্পে নিম্নবর্গ- হারুন পাশা
#