স্মৃতিগদ্য =
আমাদের রাবেয়া খালাম্মা
মনির মহিউদ্দিন
জীবনে চলার পথে কত মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি, কত ভাবে তাদের আনুকূল্য পেয়েছি তা বলে শেষ করা যাবে না।বিশেষ করে সানাম, জুয়েলের আম্মা- আমাদের খালাম্মা, রাবেয়া ইসমাইলের মত মায়েরা এ সমাজে নিরবে-নি:শব্দে যে অবদান রেখে যাচ্ছেন তা বিরল।আমার ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতার কথাটা আমি বিনীতভাবে স্বীকার করছি।
আরও একটি তথ্য শুরুতে বলে নেয়া যেতে পারে কবি-কথাসাহিত্যিক ও লোক-সাহিত্য বিশারদ ড. আশরাফ সিদ্দিকীর প্রথম গল্পের বইয়ের নাম ‘রাবেয়া আপা’- এই ‘রাবেয়া আপা’ই হচ্ছেন আমাদের খালাম্মা রাবেয়া ইসমাইল। খালাম্মার পিতার চাকরির সুবাদে শৈশব থেকেই দেশের নানা জেলায় থেকেছেন এবং পরিচিত হয়েছেন অনেক সাহিত্য-সংস্কৃতিমনা মানুষের সাথে। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরেই ময়মনসিংহের আশরাফ সিদ্দিকী, রংপুরের কবি কায়সুল হকের সাথে গড়ে ওঠে ভাই-বোনের সম্পর্ক। সেই সুবাদে সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদসহ অনেকেই সানামদের বাসায় গল্পগুজব করতে আসতেন। শিল্প-সাহিত্যমনা রাবেয়া খালাম্মা চিন্তা-চেতনায় আর দশজন থেকে সঙ্গত কারণে অনেক এগিয়ে ছিলেন। পরে আমি জেনেছি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা চিত্রকর আমিনুল ইসলাম সাহেব খালাম্মার বোনের জামাই। সে সম্পর্কও হয়তো খালাম্মাকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনেকটা অনুপ্রাণিত করেছে।
অনেকটা বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো এক ঘটনাচক্রে খালাম্মার সাথে আমাদের পরিচয়।আর তা ছিল নাটক নিয়ে আমাদের পথচলা সেই দিনগুলোর একটি বাঁক।যদিও আমরা সে ধারা নানা কারণেই অব্যাহত রাখতে পারিনি।সে এক ভিন্ন প্রসঙ্গ। আজ খালাম্মার কথা- যিনি নেপথ্য থেকেই আমাদের জন্য কাজ করেছেন।তিনি কতটুকু বড় মাপের ছিলেন সেদিন অপরিণত বয়সে না বুঝতে পারলেও আজ অনুধাবন করি।
আমাদের সাথে নাটকের দলে ছিল পরিবাগের সানাম- এই সানাম নিজের নামটাকে কি ভাবে উচ্চারণ করতে হবে আমাদের তা শিখাতো।যেমন বলতো দ্যন্তসটা খুব সফটলি উচ্চারণ করে ডাকতে হয় যেন মনে হয় ছনম।আমরা আজো সানামের সাথে এনিয়ে মজা করি।আবার আমরা কেউ এ কারণেই মজা করে ডাকতাম ছালাম ভাই।আবার কেউ বলতো ছালামত ভাই।দিলু ভাইও মজা করে ডাকতেন ছালামত। যারা নাটক করেন বিশেষতঃ গ্রুপ থিয়েটার তারা জানেন এখান থেকে প্রাপ্য ফসল এ আনন্দ উল্লাসটুকুই।বাকি শ্রম শুধু সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পদচারনা মাত্র এবং তার বিকাশের ভাবনার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল।
এরই মাঝে একজন বেশ মোটাসোটা এক তরুন আমাদের সাথে যুক্ত হয় তার নাম জুয়েল সে সানামের ছোট ভাই। দেখতে জুয়েলকেই বড়ভাই মনে হতো।জুয়েলের গলার স্বর ভারি হওয়ার কারনে দিলু ভাই সব সময় জুয়েলকে একটা পাট দিতেন।ইতিমধ্যে সারথী নাট্য গোষ্ঠীর মধ্যে মাতবরী করা নিয়ে ভাঙন লেগে গেল।দুইপক্ষ আলাদা হয়ে গেলাম- আমরা সানাম-জুয়েল এক পক্ষে রইলাম । এর মধ্যে জুয়েল একদিন বিকেলে রিহার্সালের পরে আমাদেরকে বলল চল আমাদের বাসায় চল। কিছুটা নিমরাজী হয়েই সেদিন আমরা সানাম আর জুয়েল দু’ ভাইর নেতৃত্বে পরিবাগে ওদের বাসায় যাই।আমরা টি এস সি থেকে সোজা সূর্য সেন হলের পাশ দিয়ে মাঠ পেরিয়ে পরিবাগে গেলাম।এখন তো আর সে মাঠ নেই।সেই কাটা গাছগুলোও নেই যার নামের উপর ভিত্তি করে এলাকাটার নাম হয় কাটাবন।একটা ঐতিহাসিক তথ্য দেই।ভারত ভাগের পরে যখন অনেক রিফিউজি ভারত থেকে এখানে আসে।। এরকম একটি পরিবার শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সাহেবের কাছে গিয়ে বলে আমরা থাকবো কোথায়?উনি বলেছিলেন একটা জায়গা আছে ওখানে কাটা গাছ বোঝাই ওখানে কেউ থাকতে চায়না ইচ্ছা হলে ওখানে থাকতে পার !এখন যেটা Masko shoes এবং তার বিপরীত দিকের মার্কেট এটাই ওই কাটাবনের সেই বাড়ী।ওই এলাকার প্রথম বাড়ী।এটা একটি প্লট ছিল।নিউ এলিফেন্ট রোডের কারণে বাড়ীটি ভাগ হয়ে গেছে।
‘সারথী নাট্য গোষ্ঠী’ দুটি ভাগ হয়ে যায়। এখনো হাসি পায় সেদিনের সে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কথা মনে এলে।আমরা সবাই প্রায় একই বয়সের ছিলাম ফলে অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রও আমাদের অপরিণত মানসিকতায় এটাই ছিল স্বাভাবিক। আবার নাটকের পোকা আছে সবার মাঝে এর মধ্যে সানাম আবার সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতো এবং এখনো কবিতা আবৃত্তি করে।হঠাৎ চলতে ফিরতে দুচার লাইন বলে ফেললো।
কেউ কথা রাখেনি- আমরা একটা নতুন সভাপতি খুঁজছিলাম তখনই কেউ একজন প্রস্তাব করেন সানাম জুয়েলের আম্মা- আমাদের খালাম্মাকে সভাপতি করা হোক।এটা কি দিলুভাই করেছিলেন ঠিক মনে আসছে না।খালাম্মা আমাদের সকলের আবদারের কারণেই রাজী হলেন সভাপতি হতে।এরপরে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা দলটির নাম রাখলাম ‘ঢাকা ড্রামা’।যদিও খালাম্মা কখনোই আমাদের কোন ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতেন না, তবে তার বাসায় গেলে আমাদের আপ্যায়ন ঠিকমতো হচ্ছে কিনা তার খবর নিতেন।আর জুয়েল ছিল (গত বছর কভিডের কারণে আমরা জুয়েলকে হারিয়েছি) প্রধান আপ্যায়নকারি।অনেকটা জোর করেই জুয়েল আমাদের নিয়ে যেতো।হাতিরপুল বাজারের একটা দোকান থেকে আমাদের জন্য ডালপুরি পিয়াজু নিয়ে আসতো।এ কারনে টিএসসি’র আড্ডাটা মাঝে মাঝে আমরা মিস করতাম।তখন আমরা প্রায় সবাই টিএসসি’তে নাটকের দলগুলোর সবাই সবাইকে চিনতাম। ওখানে রিহার্সাল করতো আরণ্যক ,ঢাকা থিয়েটার, নাট্যচক্র, পদাতিক আর আমরাতো ছিলামই।পরবর্তীতে দলগুলো থেকে অনেক শাখা প্রশাখার সৃষ্টি হয় ।রিহার্সালের পরে টিএসসি’র লনে দীর্ঘ আড্ডা হতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে । আলোচনা হত রাজনৈতিক বিষয়েও।এটা মাথায় রাখতে হবে যে রাজনীতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ঐতিহ্য- এখানে না চাহিলে যারে পাওয়া যায়। তবে মূল আলোচনা হতো নাটককেন্দ্রিকই।
খালাম্মা ঢাকা ড্রামার সভাপতি হবার পরে আমাদের আড্ডার ক্ষেত্রটি প্রশস্ত হলো। কিছু সুযোগ সুবিধা আমরা পেতে শুরু করলাম। এখানে একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয়।সানামের ছোটভাই টোকোনও আমাদের নানা কাজে সহযোগিতা করতো।এ বাসার কারণে একটা বড় সুবিধা হলো- যেমন নাটকের সেট রাখার একটা জায়গা হলো সানামদের বাসায়।এটা নিয়ে সব সময়ই আমরা ঝামেলায় পড়তাম। এগুলো তখন অবশ্য সানাম-জুয়েলই ঠিক করতো।আর একটা সুবিধা খালাম্মার কাছ থেকে আমরা পেতাম- বিশেষতঃ হল বুকিং এর টাকা না থাকলে খালাম্মার কাছ থেকে ধার নেয়া।তখন মহিলা সমিতির ভাড়া ছিল প্রতি শো’এর জন্য ৭০০ টাকা।হলের বুকিং এর কাজটা মূলতঃআমিই করতাম আর আমার সাথে কেউ কখনো হয়তো যেতো।আমরা তখন মাসে ৪টি প্রদর্শনী করতাম।
বেশ কিছুদিন পর খালাম্মা আমাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে শুরু করেন।এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি।সানামের একটা বন্ধু সার্কেল ছিল সংস্কৃতিমনা- যেমন হ্যাপি আখন্দ ,শম্পা রেজার নাম এই মুহূর্তে মনে করতে পরছি।এ ছাড়াও বেশ কয়েকজন।পরে আমাদের এই আড্ডায় যুক্ত হয় আবৃত্তিকার জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। এরা মূলত আবৃত্তি গান নিয়েই মেতে থাকতো।এক কথায় বলা চলে সানামদের পরিবাগের বাসাটিতে সারাদিনই একটা সাংস্কৃতিক আড্ডাবাজির চলতো।অবশ্য দিনের ওই আড্ডায় আমরা কেউ আসতাম না।
আমি ইতিহাসের ছাত্র এটি খালাম্মাকে বেশ আনন্দিত করে।এর মধ্যে একদিন রাতে জুয়েল খেয়ে যেতে বলে।আমরাও আনন্দের সাথে খাওয়া-দাওয়া করে বিদায় নেই।কি কারনে খালাম্মা আমাদের জন্য একটা হুকুম জরি করেন ,আমরা মানে আমি এবং দিলু ভাই যে দিনই আসবো যেন রাতে খেয়ে যাই।আমি দিলুভাইর চেয়ে বেশীদিন খেয়েছি।কারণ আমি আবার এখান থেকে হলে চলে যেতাম। দিলুভাই বাসায় যেতেন।তবে একটা বিষয় ছিল যদি কোনদিন না খেয়ে যেতাম, খালাম্মা এরপরে যেদিনই যেতাম ডেকে জিজ্ঞেস করতেন কেন খেয়ে যাইনি।হয়তো সেদিন আমি বাসায় যেতাম। এটা সত্যি কথা তখন তো আর মোবাইল ছিল না। ফলে আমার সকল কাজের ব্যস্ততা ,যোগাযোগ কিছু টিউটোরিয়াল পরীক্ষার প্রস্তুতি- আমাকে ছুটে ছুটে ম্যানেজ করতে হত।
খালাম্মাকে বাসায় যখনই দেখতাম লক্ষ্য করেছি ওনার হাতে কোন না কোন উপন্যাস অথবা পূজা সংখ্যা দেশ অথবা ঈদ বিচিত্রা।বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা তো থাকতোই এবং কিছুটা ওনার পেশাগত কারণেও বেশ কিছু পত্রিকা খালাম্মার কাছে আসতো। খালাম্মা তখন সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের জন সংযোগ বিভাগের এসিসষ্ট্যান্ট ম্যানেজার ছিলেন।একদিন এ নিয়ে কথা প্রসঙ্গে আমাকে বললেন, তুই একদিন আমার অফিসে আসিস।ব্যাস মতিঝিলে একটা চা খাওয়ার জায়গা হল।ওই সময় আমি ড.মুহাম্মদ ইব্রাহীম সম্পাদিত মাসিক ‘বিজ্ঞান সাময়িকী’র জন্য বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতাম।
যাই হোক টাকা না থাকলে খালাম্মা ছিলেন আমাদের ভরসা।ধার করতাম আর শোধ করতাম।
খালাম্মার কথা মতো আমি একদিন তাঁর অফিসে যাই। তিনি অত্যন্ত স্নেহের সাথে আমাকে বসতে বলেন।চা-সিংগারা আনালেন। তাঁর পানের ছোট ডিব্বাটা খুলে আমাকে পানও খেতে দিলেন।এমনিতেই মাসিক ‘বিজ্ঞান সাময়িকী’র বিজ্ঞাপনের জন্য মতিঝিল-দিলখুশায় নিয়মিত ঘোরাঘুরি করতে হ’ত।এবার একটা বিশ্বাস জন্মাল । বলতে চাই এই ‘বিজ্ঞান সাময়িকীর’ হাত ধরেই গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম বৃহৎ Non Formal Education প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞান গণশিক্ষা কেন্দ্র (Centre For Mass Education in Science) যার নেতৃত্বে আছেন দেশের সেরা শিক্ষক-পন্ডিতবর্গ। প্রতিষ্ঠানটি গড়া এবং সভাপতির দায়িত্বে আছেন ড.মুহাম্মদ ইব্রাহীম। আমি আজো এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে যুক্ত আছি এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে জীবনবাদি বিজ্ঞান শিক্ষার আন্দোলন করে যাচ্ছি।আমাদের অনেক চিন্তা-ভাবনা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সরকার গ্রহণ করেছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এনিয়ে এখনো পরীক্ষা নীরিক্ষাও করা হয়। National Geographic চ্যানেলে CMES-এর কাজ নিয়ে ডকুমেন্টারি প্রচার করেছে।এটা আমাদের শিক্ষা আন্দোলনের জন্য গর্বের বিষয়।
খালাম্মার সাথে এরপর বাসায় অথবা অফিসে নিয়মিতই আমার যোগাযোগ হত।যেমনটা হত দিলু ভাইর সাথে হোটেল পূর্বানীতে।এখানে খালাম্মা হয়তো পরোক্ষভাবে ছেলের বন্ধুদের মাধ্যমে ছেলেদের উপর পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের কথা মাথায় রাখতেন।এ পরিণত বয়সে এসে ধারণাটা মাথায় এসেছে মায়েরা সন্তানদের জন্য সব প্রচেষ্টা করেন।আর তখন তো স্বাধীনতার পরপর একটা অস্থির সময় চলছিল সব দিকেই। মারামারি তো ছিল নৈমত্তিক ব্যাপার।
প্রশ্ন উঠতে পারে এতো কিছু করে আমি লেখাপড়াই বা করতাম কখন। একটা সত্যি কথা বলি আমি কখনো ক্লাশ মিস করতাম না।আর কেন জানি মনে হত ওটা তো ক্লাসে শুনেছি ব্যস এতো গভীরে যেতাম না- যতটা ছিলাম নাটক নিয়ে।আমরা নাটক নিয়ে এতোটাই সিরিয়াস ছিলাম । আমি আর মঈনু সময় পেলেই বিকেলে রমনা পার্কের ভিতর দিয়েই হেঁটে হেঁটে বেইলী রোডে গিয়ে বিকেলের চা খেতাম।আর মঈনুর প্রিয় ছিল তখন জেসমিন কনসোর্টিয়ামের পেটিস।বেইলী রোড গেলে ওটা ওর খাওয়া চাই। কিছু কথা লিখতে আনন্দ লাগে তাই মাঝে মাঝে একটু সটকে যাই।তবে সবই আমার বলার কথা আজ অথবা কাল। তখন নাটক নিয়ে লেখা বই পড়তাম- নাটক নিয়ে লেখালিখিও করতাম।
অনেকটা গবেষণা করার মতোই লেগে ছিলাম। আমরা স্টেডিয়ামের ‘সুবর্ণ’ নামক বইএর দোকানে অর্ডার দিয়ে নাটকের উপর রচিত বই আনাতাম।আমি এবং দিলুভাই একাজে একাগ্র ছিলাম।
আমি ক্রমশঃ মতিঝিল থেকে বেশ বিজ্ঞাপন পেতে শুরু করলাম। একদিকে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দাতা, বিজ্ঞাপনী সংস্থার সাথে আমার একটা পরিচয় গড়ে উঠতে থাকে, অন্যদিকে ছিল খালাম্মার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ফোন করে আমাকে বিজ্ঞাপন দিতে অনুরোধ করা।আমার কোন ধারণা ছিল না বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ বিভাগের সাথে খালাম্মার একটা প্রফেশনাল যোগাযোগ আছে।তিনি ফোন করে এভাবে বলতেন, আমার ভাগ্নে মনিরকে পাঠালাম ওকে আপনাদের একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে দিয়েন।
এভাবে খালাম্মা আমার জন্য ফোন করে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে দিতেন।আমার অনেক পরে মনে হয়েছে খালাম্মা তো বিভিন্ন পত্রিকায় সাধারণ বীমার বিজ্ঞাপন পাঠান অনেক অনুরোধ রক্ষা করেন কিন্তু নিজের চাওয়ার কেউ ছিল না এখন একজন হলো- তা এই আমি।জানি না খালাম্মা আমার কোন পুরুষের আশীর্বাদের মানুষ ছিলেন।এরপরে বিজ্ঞাপন থেকে মাসে আমার বেশ আয় হতে থাকে।এছাড়া মহসিন ভাই নিয়মিত মাসে একটা রেডিও প্রোগ্রাম দিতেন- টিউশনি তো ছিলই- ফলে আমি ছাত্রাবস্থায় বেশ স্বাচ্ছন্দে সব কাজ করতে পারতাম।আমি অই সময়ে মাসে গড়ে ৭৫০ টাকা থেকে ১১৫০ টাকা আয় করতাম । আমি বন্ধুদেরও টাকা ধার দিতাম। এমন কী এক বন্ধুর সাবসিডিয়ারি পরীক্ষার ফি ২৫০ টাকা ধার দিয়েছিলাম।এমনি অনেক গল্প আছে। কেন জানি টাকার ভাগ্য আমার পক্ষে থাকে আবার থাকে না।আমি যখনকার কথা লিখছি তখন ’৭০এর দশক চলছে।একটা কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই- অই সময় আমার যে বন্ধুরা হলে থাকতেন তাদের বাড়ী থেকে ২০০ থেকে ২৫০টাকা আসতো।অই সময় মঈনু টাকা জমা রাখার জন্য টিএসসি’র জনতা ব্যাংকে আমাকে একটা একাউন্ট খুলে দেয়।
সানামদের বাসায় আমরা মাঝে মাঝেই যেতাম । খালাম্মা আমাকে দু’একদিন ডেকে নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতেন।একদিন আমাকে একটা পেপার ব্যাক টাইপের বই দিয়ে বললেন বইটা পড়িস।ইউরোপের রেনেসাঁর উপরে লেখা।আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না উনি আমাকে কি বুঝাতে চেয়েছেন। আমাদের বিভাগে যখন ইউরোপের ইতিহাস পড়াতো তখন রেনেসাঁকে খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়ান হত এবং আমরা জানতাম রেনেসাঁর উপরে একটা প্রশ্ন থাকবেই এটুকুই । আসলে রেনেসাঁর যে মানব সভ্যতায়- শিল্পকলায়- চিত্রকলায় এক বিশেষ আবদান আছে আমি ক্ষ্যাতু মনির কোত্থেকে জানবো সভ্যতার ইতিহাসের এতো বড় ঘটনা!
খালাম্মার বাবার বাড়ী সেন্ট্রাল রোডে।সানাম আমাকে বলেছে ওদের বাসায় ওর খালুর বেশকিছু চিত্রকলা রাখা ছিল।খালাম্মার আব্বা ব্রিটিশ আমলে ডি এম এর চাকরি করতেন।সে সুবাদে খালাম্মা বরিশালের বি এম কলেজে এবং ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজে পড়াশুনা করেছেন।খালাম্মা একদিন আমাকে বি এম কলেজের পুকুরগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন, ওগুলো কি এখনো আছে? আমি বলেছিলাম এখনো আছে । আর রিকসা করে বেলস পার্কের থেকে বি এম কলেজে আসতে পথের পাশে গ্রাম্য-ভাব-সবুজ ওনার ভাল লাগতো।বরিশালের গ্রাম্য ভাব ওনাকে মুগ্ধ করেছে।এর বেশী উনি আর কিছু বলেননি।
গ্রাজুয়েশন শেষ করে খালাম্মার কর্ম জীবন শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর টেলি-কমিউনিকেশন বিভাগে।ভাবা যায় অতো আগে খালাম্মা শিক্ষা-দীক্ষায় কতো আধুনিক আর কতখানি সাহস থাকলে বৃটিশ সেনাবাহিনীর যোগাযোগ বিভাগে কাজ করা যায়! তখন তো মানুষ টেলিফোন কি জিনিষ তা ই জানতো না।তার উপরে সম্পূর্ণ ইংরেজীতে কথা বলা- বোঝা ইত্যাদি । আজকের মিডিয়ার যুগে এটা সহজ মনে হলেও বৃটিশ শাসনের সময় এতো সহজ ছিল না।এসব গুণাবলীর কথা আমরা শুনেছি।শুরুতেই বলেছি ড.আশরাফ সিদ্দিকী খালাম্মাকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলেন ওটার নাম ছিল ‘রাবেয়া আপা’।সানাম বইটা আমাকে দিতে পারেনি।
প্রসংগত কথা বলতে হয় আখন্দ ব্রাদার্স অর্থাৎ হ্যাপি আখন্দ এবং লাকি আখন্দ এরও পরিবাগে আড্ডার জায়গা ছিল এই সানামদের বাসা। আমার সাথে এর আগে হ্যাপির কখনো কথা হয়নি যদিও ওরাও আজিমপুর কলোনীতে থাকতো আমিও ওখানে থাকতাম । বহুদিন লাকির সাথে একত্রে সানামদের বাসায় সন্ধ্যায় আড্ডা মেরেছি । ওর সাথে আড্ডা মানে হঠাৎ হঠাৎ গিটারের তার ঝনাৎ ঝন করে উঠতো।আমি দু’দিন আড্ডার শেষে রিকসায় লাকির সাথে একত্রে আজিমপুরের বাসায় ফিরেছি।ও রিকসায় বসেই গিটারের তারের সাথে খেলা করতো।এ সবই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে খালাম্মা-সানামদের সৌজন্যে।
#