গল্প =

অতুল

আবু সাইদ কামাল

অতুল মায়ের গর্ভে এসেছে বেশ নাটকীয়ভাবে।

সাহেব কোয়ার্টার মহিলা হোস্টেলের একটি মেয়ে বিষপান করেছে। বিষয়টা নিশ্চিত হওয়ার পর মুহূর্তেই খবরটা হোস্টেল থেকে আশেপাশে চাউর হয়। মেয়েটার সাহায্যে এগিয়ে যায় হোস্টেলের অন্য মেয়েরা।  ততক্ষণে তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন।

মেয়ের বাড়ি পাহাড়-ঘেঁষা গ্রামে। পুরুষ হোস্টেল-সুপারের বাড়িও একই গ্রামে সীমান্ত-ঘেঁষা গারো পাহাড়ের পাদমূলে। তার শিক্ষক মনিন্দ্র মারাকের বড় মেয়ে মেধাবী ছাত্রী এই সুদীপ্তা ময়মনসিংহ জেলা শহরে সরকারি কলেজে অর্থনীতিতে অনার্স পড়ে।সীমান্ত ঘেঁষা দুর্গম গোবিন্দপুর গ্রামের সে-ই প্রথম মেয়ে, যে অনার্সে পড়াশোনা করছে। নিরীহ এবং মেধাবী মেয়েটি হঠাৎ বিষপানে আত্মহননের পথ বেছে নিল কেন?

প্রশ্নটা সবার মনেই দানা বাঁধে। তখন অবশ্য প্রশ্ন খোঁজার চেয়ে বিপন্ন মেয়েটির সঙ্কটাপন্ন জীবন রক্ষা বড় হয়ে দাঁড়ায়। সে জন্য প্রয়োজন জরুরি চিকিৎসা। প্রাণেশ এবং শহরে অবস্থানরত ঐ গাঁয়ের আর এক ছেলে দাগ্লেস দু’জনে অচেতন সুদীপ্তাকে নিয়ে  ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করে। সময়ানুগ চিকিৎসায় তাদের সব উৎকণ্ঠা  সরিয়ে রেখে সুদীপ্তা জ্ঞান ফিরে পায়- বেঁচে যায়।  

প্রাণপ্রিয় মেয়ের এই দুঃসংবাদ শুনে গ্রাম থেকে ছুটে আসেন তার মা-বাবা। কয়েকদিন হাসপাতালে চিকিৎসার ফলে সুস্থ হয় সুদীপ্তা। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর আর হোস্টেলে যায়নি। মা-বাবা নিয়ে যায় গ্রামে। পরদিনই মা একান্তে মেয়ের কাছে বিষপানের কারণ জানতে চায়। সুদীপ্তা মুখ খুলে না। বিষন্ন মেয়েটি লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আর শুধু চোখের জল ফেলে।

মেয়ের এ অবস্থা দেখে মায়ের মন মানে না। সুদীপ্তার মাথায় স্নেহের হাত বুলাতে বুলাতে এক পর্যায়ে কেঁদে বলে, আমি তোর মা! আমার কাছে যদি খুলে না বলিস, তাহলে কোনো সমস্যা হয়ে থাকলে তার সমাধান হবে কী করে? তোকে ঘিরে আমাদের কতো আশা-ভরসা, তোর বাবার কত স্বপ্ন!

মায়ের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত সে তার আত্মহনন প্রচেষ্টার বিষয়ে মুখ খুলতে শুরু করে। বিষপানের পর থেকে সুদীপ্তা আর আগের প্রণোচ্ছল মেয়েটি নেই। জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে পৌঁছানোর পর থেকে জীবনের প্রতেই মায়া কমে গেছে তার। ফ্যাল ফ্যাল করে আকাশের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকে। নির্বিকার এবং বিষন্ন সুদীপ্তা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে শেষ পর্যন্ত মাকে জানায় যে, পাঁচ মাসের অন্তসত্ত্বা সে।

কথাটা শুনেই আঁতকে উঠে মা। তার জিহ্বা তালুতে ঠেকে। কিছুক্ষণ কোনো কথাই আসেনি মুখে। তবু একটু দম নিয়ে বলে, এ্যাঁহ্- এ কী সর্বনাশের কথা শুনাচ্ছিস তুই! তোর বাবা স্বল্প আয়ের সামান্য একজন স্কুল শিক্ষক। তোর প্রতি এত বড় স্বপ্ন নিয়ে জেলা পর্যায়ে রেখে পড়ালেখা করাচ্ছে। তোর পড়ালেখার খরচ জোগাতে গ্রামে আমরা কত কষ্ট করছি। অথচ তুই এ কী শুনালি রে!

এ জন্যই তো মা আমি বাঁচতে চাইনি। কেনো তোমরা আমাকে বাঁচালে!

বলেই সুদীপ্তা বোবা কান্নায় ভেঙে পড়ে। দু’চোখ হয়ে উঠে বর্ষার নদী। অমনি হঠাৎ করেই সে আবার বেপরোয়া হয়ে যায়। অকস্মাৎ দৌড়ে গিয়ে আবার আত্মঘাতী হতে চায়। মা বুঝতে পেরে মরিয়া হয়ে মেয়েকে ঝাপটে ধরে। তাকে বুঝায়। মায়ের স্নেহের মায়ায় আবার সে শান্ত হয়।

কীভাবে এমনটা হলো, জানতে চাইলে সুদীপ্তা মাকে জানায়, এর জন্য দায়ী তার পিসতুত ভাই। সুদীপ্তার পিসি দুর্গাপুর মিশনারি হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফনার্স। পিসে মশাই ঐ হাসপাতালেরই ব্যস্ত ডাক্তার। পেশাগত কারণে মা-বাবা দুজনই এত ব্যস্ত যে সংসারে সন্তানদের সময় দিতে পারে না। সেই সুযোগে তার পিসতুত ভাই সুরঞ্জন অনেকটাই বখে গেছে। যদিও মা-বাবার চাপে পড়ালেখাটা চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় উপজেলা সদরের কলেজে পাসকোর্সে স্নাতক পড়ছে। তবে পড়ালেখার চেয়ে মদ্যপানে বেশি আসক্ত। শুধু যদি গারো মদ ‘চু’ তেই সীমাবদ্ধ থাকতো, তাহলে বিপদের তেমন কারণ ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে সে হয়েছে নানা রকম মারাত্মক ড্রাগে আসক্ত।

সুদীপ্তা গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সময় পিসির সাথে দেখা করে যেতো। পিসি তাকে বেশ আদর করতো। কখনো একদিন পিসির বাড়িতে অবস্থান করে বিশ কিলো দূরে গ্রামের বাড়ি যেত সুদীপ্তা। এ সময়ে পিসতুত ভাই সুরঞ্জন সুযোগ পেলেই সুদীপ্তার সাথে সখ্য গড়ে তুলতে চেষ্টা করতো। সুরঞ্জন সম্পর্কে সুদীপ্তা সচেতন।

কিছুদিন পর ফের সুদীপ্তা কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছে। তখন কলেজে লম্বা ছুটি। পরীক্ষা চলছে। সুদীপ্তা দুর্গাপুর হয়ে বাড়ি ফিরছে। দুর্গাপুরে বাসস্ট্যান্ডের পাশেই মিশনারি হাসপাতাল। ওখানে সোমেশ্বরী নদীর তীরে এসে বাস থামে। পিসির সাথে দেখা না করে কি করে বাড়ি যায়! দেখা হয় পিসে মশাইয়ের সাথেও। সুদীপ্তা পিসির সাথে দেখা করেই বাড়ি ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো শুরু করে। বাঁধ সাধে পিসি। বলে, বড় ছেলে সুরঞ্জন ভীষণ অসুস্থ। অতিরিক্ত ড্রাগ নেওয়ার কারণে এমন অসুস্থ হয়েছে যে, বেশ কিছুদিন যাবৎ শয্যাশায়ী। তাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত মা-বাবা।

বিকেলে সুদীপ্তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে পিসি। রাতে অবস্থান করার পর সকালেই বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হতে চায় সুদীপ্তা। কিন্তু পিসি এমন অসহায়ভাবে বলে যে, আর উপেক্ষা করতে পারে না সুদীপ্তা। পিসি বলে, তুমি যদি সুরঞ্জনের একটু সেবা করতে পারতে, ভালো হতো। পেশাগত কারণে ইচ্ছে থাকলেও আমি ছেলেটার উপযুক্ত সেবা দিতে পারি না। এখন তো তোমার কলেজও ছুটি। এখানে কিছুদিন থাকো না তাহলে!

সুদীপ্তার ক’দিনের সেবায় সুরঞ্জন বেশ সুস্থ হয়। একদিন বাড়িতে কেউ নেই। সুরঞ্জন সেই সুযোগ নেয়। জোরপূর্বক ধর্ষণ করে তাকে। কী করবে সুদীপ্তা ভেবে পায় না। পরদিনই সে বাড়ি চলে যেতে চায়। কিন্তু পিসি বাধা দেয়। পিসি তো আর জানে না তার গোপন সর্বনাশের খবর। দু’দিন পর ফের সুরঞ্জন কৌশলে বাসা নির্জন করে। তারপর ফের অনুরূপ সুযোগ নেয়। এরপর সুদীপ্তা পিসির মানা আর মানেনি। তৃতীয় দিন গাঁয়ের বাড়ি চলে যায় সে ।

মনমরা মেয়েকে দেখে মার মনে দুঃচিন্তা ভিড় করে। কী হয়েছে জানতে চেয়ে বলে, কী রে সুদীপ্তা! এবার বাড়িতে আসার পর থেকে তোকে লক্ষ করছি, মনে হয় কেমন মন মরা হয়ে থাকস তুই! সত্যি করে বলতো, কী হলো তোর?

এমনিই মনটা খারাপ মা, তেমন কিছু হয় নাই।

সুদীপ্তা মার কাছে বিষয়টা আড়াল করলেও এ নিয়ে সে নিজের সাথে বেশ বোঝাপড়া করে। শেষে এটাকে নিছক একটা দুর্ঘটনা বলে মনে করে এবং পড়ালেখায় মনোযোগী হয়। তিন মাসের সময় সে শরীরের অসঙ্গত আচরণে টের পায়। অন্তঃসত্ত্বা হয়ে গেছে বুঝতে পেরে সে ভেতরে ভেতরে বেশ অস্থির। মনে মনে সুরঞ্জন আর পিসির প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে দুর্গাপুর যায়। ক্ষুব্ধ সুদীপ্তা পিসির বাড়িতে রাতে অবস্থান করে সুরঞ্জনকে ঘটনা খুলে বলে। কিন্তু দুরাচার সুরঞ্জন তাকে পাত্তাই দেয় না। জবাবে আরও বলে, কোথায় কী না কী করছো, এখন দায় চাপাতে আসছো আমার ঘাড়ে! মাত্র দু’দিনেই এমন হয়ে যায় না কি!

চরম দুঃসময়ে অঘটনের নায়ক সুরঞ্জনের কাছ থেকে হতাশাজনক জবাব শুনে সুদীপ্তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ভাবে, তাহলে কী করবে সে!

ভাঙা বুকে সে ফের চলে যায় হোস্টেলে। অপেক্ষা করে। ভাবে সুরঞ্জনের বোধোদয় হবে। একমাস পর আবার পিসির বাড়ি যায় সুদীপ্তা। ফের কথা বলে সুরঞ্জনের সাথে। কিন্তু তার একই কথা। তাহলে কী করবে সুদীপ্তা? কী উপায় হবে তার! উদভ্রান্ত সুদীপ্তা। কিছুই ভাবতে পারে না। এ অবস্থায় জীবনের প্রতি চরম ঘেন্না জন্মে। হোস্টেলে ফেরার পথেই আত্মহননের সিদ্ধান্ত নেয়- সে ভাবনা থেকেই বিষপান করে।

এ পর্যন্ত শুনে মা তার যত ক্ষোভ ঢালে স্বামী মনিন্দ্রের উপর। স্বামীকে ঘটনা জানিয়ে বলে, তোমার বোন আর ভাগ্নেই আমার মেয়ের এ অবস্থার জন্য দায়ী।

সব শুনে মনিন্দ্রের মাথায় হঠাৎ বজ্রপাত হয়। চরম বিপদে বড়বোনের প্রতি আস্থা নিয়ে পরদিন ভোরে দুর্গাপুর রওয়ানা হয় বাবা। সাইকেল যোগে দেড় ঘন্টার মাঝেই বোনের বাড়ি গিয়ে পৌঁছে। অফিসে যাবার আগেই বড় বোনকে সব খুলে বলে। জবাবে দিদি বলে, এত দুশ্চিন্তার কী আছে! ওকে নিয়ে এসো এখানে। আমাদের হাসপাতালেই সম্ভব হবে। সন্তান নষ্ট করে দিলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।

কী বললে তুমি!

এটাই তো সহজ পথ।

কেনো, ওদের বিয়ে দেওয়া যায় না!

সুরঞ্জন কি বিয়ে করবে?

করবে না মানে!

ঠিক আছে, রাতে ছেলে এবং তার বাবার সাথে কথা বলে দেখি।

মনিন্দ্র রাতে অবস্থান করে বোনের বাড়িতে। দিদি প্রথমে ছেলের সাথে কথা বলে। কিন্তু মা’র সাথে ছেলে পুরো ঘটনা অস্বীকার করে। তারপর দিদি ছেলের বাবার সাথে কথা বলে। সুদীপ্তার সাথে ছেলের বিয়ের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সুরঞ্জনের বাবা বলে, একটা ভিক্ষুকের বাড়িতে বিয়ে দেব আমার ছেলেকে!

অর্থ-বিত্ত আর প্রতিপত্তির অহংকারে অন্ধ ভগ্নিপতির এমন দাম্ভিক উচ্চারণসহ সব কথাই পাশের কক্ষ থেকে রাতে শুনেছে মনিন্দ্র। পরদিন ভোরেই সে বোনের বাড়ি থেকে রওয়ানা হয়। বিদায় বেলায় বোনের শীতল আচরণেও মনে মনে ক্ষুব্ধ হয় মনিন্দ্র।

হেমন্তের ভোর। বাইসাইকেলে দুর্গাপুর থেকে সোজা উত্তরে নলুয়াপাড়া হয়ে সীমান্ত পথে যায় প্রথমে। তারপর সীমান্ত সড়কে পুবদিকে এগোয়। উত্তর পাশে কাছেই গারো পাহাড়। পাহাড় এলাকার শিশু টিলাগুলো এপারের সমতল ভূমিতে যেনো এখানে সেখানে খেলা করছে। ওদের ঘিরে আছে কাঁচা সোনারঙের আধপাকা ধানের ক্ষেত। বামে কোথাও আধাকিলো দূরে, কোথাও এক কিলো দূরে সীমান্ত রেখা।  বড় পাহাড়গুলো সব ওপারে।

সীমান্ত সড়কের ডানে আদিগন্ত ফসলি মাঠ। পাহাড়ের সমান্তরাল পূবদিকের এ পথে যেতে হবে প্রায় আঠার কিলো পথ। আহা কী অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি গারো পাহাড়ের পাদদেশ! উত্তরে চিরহরিৎ গারো পাহাড়। দক্ষিণপ্রান্তে তার পাদমূল থেকে হেমন্তের সোনালি ধান-ফসলের ঢল বইছে সমস্ত পাদদেশ এলাকায়। এই যে এত সুন্দর পাহড়ি নিসর্গ, শিশির ভেজা ভোরের সোনাফলা মাঠের অনুপম দৃশ্য, পুবদিগন্তে শিশু সূর্যের হাসি-ঝরা কচিরোদ; এসব কোনো কিছুই মনিন্দ্র’র মনে রেখাপাত করে না। তার মনে যে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে, বুকে উঠেছে যে অশান্ত ঝড়, তা আর কোনো ভাবেই থামতে চাচ্ছে না। কী করে থামবে! নিজের সহোদরা বোনের জামাই অহংকারে তুঙ্গে উঠে তাকে কি না ভিক্ষুক বলে! এই দুঃখ কেমনে সয় মনে…?

মনিন্দ্র ভাবে, আমি হতে পারি  গরীব। একটি মিশনারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বল্প বেতনভূক একজন শিক্ষক মাত্র। কায়-ক্লেশে সংসার চলে। তবু তো সাধ্যমত পড়ালেখা করিয়ে নিজের মেয়েকে ঘিরে স্বপ্নের বাগান রচনা করছিলাম। কত সাধের সেই স্বপ্নের বাগান! সযত্ন লালন আর নিরন্তর পরিচর্যায় যে সময় ফুলের পাপড়ি মেলতে শুরু করেছে, সে সময়ই কিনা বোন আর বোনের ছেলে বোলড্রোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিলো আমার সম্ভাবনাময় বাগান। আহা! তিলে তিলে গড়ে তোলা এ বাগানের সর্বনাশ কী করে দেখবো আমি!  সম্ভাবনাময় একটি বিকশিত গোলাপ বাগান কিনা একটি ধ্বংসকীটের দংশনে বিনাশ হয়ে যাবে! না, কোনোভাবেই মানতে পারবো না।

তাই বাইসাইকেলের প্যাডেল চাপে আর মনে মনে সে পণ করে, প্রয়োজনে আইনী লড়াই করবো। তবু এ অন্যায়ের প্রতিকার চাইবো। তবে তার আগে আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।

পরদিনই সকালে পাঁচ কিলো দূরে মায়ের বাড়ি যায়। বৃদ্ধা মা এবং ছোটবোনকে ঘটনা বলে পাঠায় দুর্গাপুর দিদির বাড়িতে। দু’দিন পর ওরাও বিফল হয়ে ফিরে আসে। অনন্যোপায় হয়ে মনিন্দ্র শেষ পর্যন্ত আদালতের আশ্রয় নেয়। মামলা চলতে থাকে। যায় মাসের পর মাস।

এদিকে সুদীপ্তার সন্তান প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসে। গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে গ্রামে না রেখে সন্তান প্রসবের জন্য পাঠানো হয় হালুয়াঘাট আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে মিশনারি হাসপাতালের পাশেই আত্মীয়ের বাড়ি। পায় চিকিৎসার পূর্ণ সহযোগিতা। ক’দিনের মাঝেই সুদীপ্তা ছেলে সন্তান প্রসব করে। তাদের সমাজে এরূপ সন্তানকে আর দশটি স্বাভাবিক শিশুর মতই সযত্নে লালন-পালন করা হয়। অতীতে কিংবা সমকালেও এরূপ সন্তানকে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে দেখা গেছে। বলা যায়, এরূপ ক্ষেত্রে রয়েছে তাদের সামাজিক স্বীকৃতি।

মামলা চলাকালেই দুশ্চরিত্র সুরঞ্জন তাদের এলাকায় আর এক অঘটন ঘটায়। গারো মদ চু তৈরি করে যে ভ্রষ্টা মেয়ে, তারই এক কন্যার সাথে অবৈধ সম্পর্ক হয়। সেখান থেকে আর রেহাই পায়নি। ওখানে সে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। ঐ ঘটনায় বাবা-মা’র বিত্ত-বৈভবের দম্ভ একেবারে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

ফাঁদে পড়ে যে মেয়েকে বিয়ে করেছে, সে শুধু অল্প শিক্ষিতাই নয়, স্বভাবে সুরঞ্জনের মতই। তুলনায় বাবা গরীব হলেও সুদীপ্তা মেধাবী। ছিল উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত। এদিকে সন্তান লালন-পালন করতে গিয়ে সুদীপ্তার সেই মেধার দীপ্তি আর বিস্তারিত হতে পারেনি। পিসতুত ভাইয়ের লালসার যুপকাষ্টে বলি দিতে হয় মেধাবী একটি জীবন।

সুদীপ্তা তার সন্তানকে মানুষ করার জন্য জীবন সংগ্রামে ব্রতী হয়। ছেলেকে তো মানুষ করতেই হবে। এ জন্য সে একটা এনজিওতে চাকুরিও নেয়। ছেলেটা ধীরে বড় হতে থাকে। চলতে থাকে মামলাও। কয়েক বছর পর মামলার রায়ে সন্তানের পিতৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু সুদীপ্তা? সুরঞ্জন তো ততদিনে অন্য একটি মেয়ের স্বামী। সুদীপ্তা তাই অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে শিশু সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ার প্রয়াস চালায়। ভালো বিয়ের ঘর এলেও সুদীপ্তার একমাত্র সন্তানের দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনের সব চাওয়া পাওয়া বিসর্জন দেয়।

আত্মনির্ভরশীল সুদীপ্তার ভুবন একমাত্র সন্তান অতুলকে ঘিরে। ছেলে বড় হতে থাকে। পাঁচ বছর বয়সে দেয় স্কুলে। সুদীপ্তা নিজে পড়ালেখা করায়। কত স্বপ্ন দেখে ছেলেকে নিয়ে। ছেলে বড় হতে থাকে আর বুঝতে থাকে মায়ের কষ্টের কথা। সব শিশুর বাবা আছে, অতুলের নেই। এমন প্রশ্নের জবাবে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা ছেলেকে দিতে পারেনি মা।

তবে সুদীপ্তা সব সময় সন্তানকে ঘিরে তার স্বপ্নের কথা বলে। ছেলেটা যে সময়ে এসএসসি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন মায়ের পেটে প্রচণ্ড ব্যথা দেখা হয়। বাবা মনিন্দ্র মেয়েকে নিয়ে যায় উপজেলা হাসপাতালে। সেখান থেকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সুদীপ্তার মরণব্যাধি ক্যান্সার শনাক্ত হয়। জীবনঘাতী এ ব্যাধি ততদিনে সারা দেহে শেকড় ছড়িয়েছে। দ্রুত তার অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। সুদীপ্তার ছেলে যখন এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ফরম পূরণ করেছে, তখন হাসপাতাল থেকে তাকে ফেরৎ দেওয়া হয়। বাড়িতে আনা হয় মুমূর্ষু সুদীপ্তাকে। মানুষের এ নিষ্ঠুর সমাজ যেমন তার প্রতি অবিচার করেছে, প্রকৃতিও বুঝি তার প্রতি তেমনি নির্মম হয়েছে!

মুমূর্ষু মায়ের শিয়র ছেড়ে পড়ার টেবিলে বসে না সুদীপ্তার ছেলে অতুল। একমাত্র মাকে ঘিরে যার ভুবন, জন্মের পর যে বাবাকে দেখেনি কোনোদিন, তার প্রতি কেনো ঈশ্বর এতটা নির্মম হবে! এজন্য গীর্জায় প্রার্থনা করে যীশুর কাছে প্রার্থনা করে অতুল। এক পর্যায়ে মায়ের জবান বন্ধ হয়। অতুল মায়ের মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে বসে থাকে। যেনে কিছুতেই সে মাকে যেতে দেবে না।

মায়ের জবান যে বন্ধ হয়, তা আর খুলেনি। ইশারায় ছেলের সাথে দু’দিন মা কথা বলেছে বটে। তৃতীয়দিন আর পারেনি। মায়ের মাথা কোলে নিয়ে অতুল কেবল নীরবে চোখের জল ফেলে। প্রথম দু’দিন মা চেয়েছে প্রাণাধিক পুত্রের চোখের জল মুছতে। তৃতীয়দিন নিথর হাত তার মনের কথা রাখেনি। তিনদিন-তিনরাত সে মায়ের মাথাটা নিজের কোলে রেখেছে। আর কারও কাছে দেয়নি। তবু পারেনি…

এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে মায়ের শোক বুকে নিয়ে। ফলাফল মোটামুটি ভালো করেছে অতুল। পাশের উপজেলা সদরের কলেজে ভর্তি করা হয়েছে তাকে। নানাই সাথে গিয়ে ভর্তি করে দেন। থাকে হোস্টেলে। কলেজ ছুটি হলে অতুল বাড়ি আসে। বাড়ি এলে জগতের দুঃসহ হাহাকার তাকে ঘিরে ধরে। কেমন যেনো চুপচাপ থাকে। কথা বলে কম। মিশেও না কারো সাথে।

কাছেই গারো পাহাড়। মাত্র দু’শ গজ দূরে। ঐ পাহাড় থেকে নেমে আসা মঙ্গলেশ্বরী নদীর তীরে গাছতলায় একাকী বসে চুপি চুপি কাঁদে। তার এ কান্না সইতে পারে না পাহাড়। সেও ঝর্নাধারায় অশ্রু বিসর্জন করে। কাঁদে হেমন্তের ভোর। শিশির জলে সিক্ত থাকে ঘাস, কান্নাজলে ভেজা থাকে ভোরের মাঠের ফসল আর গাছের পাতারা। তার নীরব এ কান্না পর্যবেক্ষণ করে তার নানা।

সেদিন বিকেলে গাছতলায় যখন অতুল একাকী বসে নীরবে কাঁদছে, তখন দূর থেকে নানা তা খেয়াল করে চুপি চুপি কাছে যায়। হঠাৎ ভূত দেখার মত সামনে আভির্ভূত হয়ে নানা দেখে, অতুলের দু’চোখ উপছে পাহাড়ি নদীর মত অবিরল ঢল বয়ে যাচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখে নানা কি স্থির থাকেতে পারে! হাউমাউ করে কেঁদে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রিয় সন্তানের অসহায় আদরের দুলালকে। নাতির সাথে কান্নায় একাকার হয়ে নানা। অতুলকে নিয়ে আসে বাড়িতে।

নানা মনিন্দ্র মাস্টার সব খুলে বলে অতুলের নানিকে। অতুলের মাথায় স্নেহের হাত বুলাতে বুলাতে নানি আবেগ জড়ানো গলায় বলে, অতুল! মা নেই তাতে কী, আমরা তো আছি না কি রে? আমরাই তোর মা-বাবা।

অতুল তখন নানির কোলে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শুধু কাঁদে। কোনো কথা বলতে পারে না।

কদিনের ছুটি শেষে অতুল আবার কলেজে ফিরে যায়। বিষন্ন অতুল ক্লাস শেষে বিকেলে হোস্টেলে ফেরে। অন্য ছেলেদের মতো রাতে পড়াশোনা করে। যখন রাত গভীর হয়, তখনই মাকে স্মরণ করে বেসামাল হয়ে যায় অতুল। রাজ্যের কান্না তাকে দখল করে নেয়। অন্য সহপাঠীদের চোখে ফাঁকি দিয়ে নিচু স্বরে ক্রমাগত বলতে থাকে, মা- মা! মা-মা…

বলেই সে কান্না শুরু করে। তার বেসামাল কান্না-প্রবাহ এতটাই হৃদয়গ্রাহী হয়, যে তা না শুনে বুঝতে পারে মা হারা সন্তানেরা মায়ের জন্য কতোটা আবগপ্রবণ হতে পারে। তার এ অতলস্পর্শী গোপন কান্না সব সময় আড়াল করে রাখতে সচেষ্ট হয়। গভীর রাতে তার কান্না এমন এক অপার্থিব গুঞ্জন সৃষ্টি করে, যা সহপাঠীদের তা আবিস্কার করতে উদ্বুদ্ধ করে। অন্তর্ভেদী সেই কান্না  শুনে ওরাও শান্ত থাকতে পারে না, নিজেরাও কাঁদে।

এক পর্যায়ে হোস্টেলের সবাই তার লুকিয়ে কান্নার খবর জেনে যায়। সহপাঠীরা তাকে বুঝিয়ে সান্তনা দিতে চায়। কোনো প্রবোধই তাকে শান্ত করতে পারে না। এ কারণে পড়ালেখায় সে মনোযোগী হতে পারেনি। ক্লাসের মূল্যায়ন পরীক্ষাগুলোতে আশানুরূপ ফলাফল করতে পারে না। অশান্ত অতুল সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়িতে যায়। মায়ের স্মৃতিগুলো অন্তহীন শূন্যতার মাঝে তাকে অক্টোপাশের মতো আঁকড়ে ধরে। এমন হৃদয়-ভাঙা হাহাকারে কী করে স্থির থাকে সে!

তার নানার বাড়ির উত্তর পাশে দু’তিন বাড়ির পরই আন্দাখালি নামের খাল। ঐ খালের উত্তর পাড়ে বলরাম রংদির শূন্য ভিটা। নির্জন ঐ ভিটা থেকে মাত্র দু’তিন ক্ষেতের পরই সীমান্ত পিলার। তারপরই গারো পাহাড়। ভিটা জুড়ে নানাজাতের গাছ। ঐ স্থানে মানুষের যাতায়াত নেই বললেই চলে। সেই নির্জন বাগানের মাঝখানে একটি গাছতলায় গিয়ে বসে সে। এমন নিবিড় স্থানে বসলেই মায়ের জন্য চরম হাহাকারে উথলে উঠে প্রাণ। তখন সে কি না কেঁদে শান্তি পারে। মায়ের জন্য প্রাণভরে কাঁদতে পারলেই ভেতরের যন্ত্রণা থেকে শান্তি পায়। এভাবে দীর্ঘক্ষণ সে শূন্যভিটার নির্জন বাগানে কাঁদে।

ওদিকে বাড়িতে তাকে খোঁজাখুজি করে হয়রান হয় নানা-নানি। পরপর তিনদিন যাবতই এভাবে সে বাড়ি থেকে নিখাঁজ হয়। নানা-নানি তার এরূপ নিখাঁজ হওয়ার কারণ জানতে চায়। কিন্তু নানা ছুতোয় আসল কথা আড়াল করে রাখে। শুধু তাই না, এ ব্যাপারে বেশ সতর্ক হয়। চতুর্থ দিন সে আর শূন্য ভিটায় যায় না। নানা-নানির সাথে বাড়িতেই কাটায়। পঞ্চমদিনে দুপুর বেলায় সে আবার শূন্য ভিটায় সেই পরিচিত গাছ তলায় গিয়ে বসে। অমনি কান্নারা এসে ঘিরে ধরে। সে আবার তার নিজস্ব ভাষাভঙ্গিতে ক্রমাগত মা…মা… মা…বলে বেসামাল কান্নাপ্রবাহে ভাসে। কাঁদতে কাঁদতে সে ভাবে, মানুষ মরে গেলে কেথায় যায়…?

এ বিষয়ে সে খ্রিস্ট ধর্মে পড়েছে। পড়েছে গারোদের আদিধর্ম সম্পর্কেও। তার মনে খটকা লাগে। মনে মনে বলে, তাহলে কোনটা ঠিক? খ্রিস্ট ধর্মে যা আছে তা, নাকি গারোদের আদি ধর্ম সাংসারেক। আদিধর্ম মতে তার মা’র আত্মা চিকমাং পাহাড়ে গেছে! অনেক ভেবে সে আবিস্কার করে, দু’টি ধর্মের মূল ভিত্তিই তো বিশ্বাস। অতুল ভাবে, সে গারো মায়ের সন্তান। কাজেই সাংসারেক মতে তার মায়ের বিদেহী আত্মা চিকমাং পাহাড়েই যেতে পরে। অতুল নির্জন বাগানে বসে সিদ্ধান্ত নেয়, চিকমাং পাহাড়ে যাবে। সে জেনেছে, মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে চিকমাং পাহাড়ই সবচে উঁচু। গারো পাহাড় থেকে বাংলাদেশের পাদদেশ এলাকায় পাঁচ কিলো দক্ষিণে গেলেই সেই চূড়া দেখা যায়। প্রায় পঁচিশ কিলো দক্ষিণ থেকেও দেখা যায় সেই চূড়া। অতুল ভাবে, সেই পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে না পারলেও সেই পাহাড়পাদমূলে গিয়ে চিৎকার ডাকলে নিশ্চয় মা সাড়া দেবে। সেই পাহাড় তো বেশি দূরে নয়। বড়জোর ত্রিশ-চল্লিশ কিলো। এই তথ্যটা জেনেছে নানার কাছে।

সিদ্ধান্ত নিয়ে সে আর দেরি করেনি। তার কাছে যে সামান্য টাকা ছিল তা নিয়ে পরদিন ভোরে রওয়ানা হয়। আগের রাতে সে কিছু তথ্য নিয়েছে। এই গ্রামেরই দু’জন লোক লুকিয়ে ওপারের আত্মীয়দের সহায়তায় মেঘালয়ের বাঘমারার উত্তরে একটি কয়লা খনিতে কাজ করে। একই নৃগোষ্ঠীর বলে লুকিয়ে কাজ করতে তাদের সমস্যা হয় না। অতুলও সিদ্ধান্ত নেয়, প্রথমে সেই কয়লা খনিতে যাবে। কয়লা খনিতে কাজ করে কিছু টাকা উপার্জন করে তবে চিকমাং পাহাড়ে মায়ের খোঁজে যাবে।

সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার জন্য ভোর বেলাটাই বেছে নেয়। এ সময়ে পাশের গ্রামের কচুগড়ার খাল বেয়ে সীমান্ত পার হবার মতলব আঁটে। তাছাড়া অতি ভোরে কড়া পাহাড়াও থাকে না।

সিদ্ধান্তনুয়ায়ী সে ভোরের অভিযানে সফল হয়। কিছুটা উত্তরেই পাহাড়ের গা বেয়ে চলে গেছে বাস চলাচলকারী পথ। পাহাড়ে ওঠার অভ্যেস তার আছেই। অতুল সকালের বাসে চেপে বাঘমারা যায়। সেখান থেকে যায় কয়লাখনিতে। কয়লা খনিতে কাজ নিতে গিয়ে বিপাকে পড়ে। সেখানে তার মতো কিশোরদের কাজে নেয়া হয় না। তখন কী করবে সে, ভেবে পায় না। হাতের টাকাও শেষ হয়ে আসে। ভাবে, তাহলে উপায়? আগে তো থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে বেঁচে থাকতে হবে।

অনন্যোপায় হয়ে শেষে খনির কাছেই এক চায়ের স্টলে কাজ নেয়। স্টলে সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি। খাবারে বেশ কষ্ট দেয়। দু’বেলা দুটো করে রুটি, একবেলা ভাত। তবু ভরপেট ভাত দেয় না। চার-পাঁচদিনেই অতিষ্ঠ হয়ে যায় অতুল। ক্ষুধা পেটে নিয়ে চা স্টলের বেঞ্চে শুয়ে ঘুমাতে যায়। গভীর রাতে মা’র কথা মনে হলে কান্না আসে। কঠোর বাস্তবতায় দুর্বিষহ জীবন অসহ্য লাগে। এভাবে নানান কিছু ভাবতে ভাবতে রাত গভীর হলে ঘুমিয়ে যায়। স্বপ্নে সে মায়ের দেখা পায়। মা বলেন, অতুল! তুমি বাড়ি চলে যাও! এখানে তুমি ক্ষুধায়-অনিদ্রায় কষ্ট করতেছো। ওদিকে তোমার নানা-নানি তোমাকে খুঁজে হয়রান।

আমি তো চিকমাং পাহাড়ে তোমার কাছে যাবো মা!

না, তোমাকে সেখানে যেতে হবে না। চিকমাং পাহাড়-চূড়া এতই খাড়া এবং উঁচু যে, সেখানে কোনো মানুষ যেতে পারে না। সেখানে থাকে কেবল সাংসারেক মান্দিদের বিদেহী আত্মা। পূনর্জন্মের আগ পর্যন্ত আত্মারা সেখানে থাকে। এখন আমিই তো তোমার কাছে এসেছি।

তাহলে আমি এখন কী করবো?

তুমি শিগ্গির বাড়ি চলে যাও।

কিন্তু তুমি…, তোমাকে ছাড়া আমার যে ভাল্লাগে না মা!

বলেই অতুল কাঁদতে থাকে। অমনি তার সাথে শুয়ে থাকা অপর স্টলবয় ধাক্কা দেয়। সাথে সাথে ভেঙে যায় ঘুম। অনেকক্ষণ সে স্বপ্নের ঘোরে পড়ে থাকে। বাকি রাত দু’চোখে ঘুম আসেনি। অনেক ভেবে-চিন্তে সে সিদ্ধান্ত নেয়, স্বপ্নে পাওয়া মায়ের আদেশ মেনে বাড়ি চলে যাবে সে। বাড়ি ফিরে যাবার কথা ভেবেই হোঁচট খায়। ভাবে, হাতে তো টাকা নেই, কী করে যাবে সে…?

স্টল মালিক তো কোনো টাকা দেবে না। সে তো কাজ নিয়েছে পেটে-ভাতে। অর্থাৎ স্টলে কাজ করবে- খাবে এবং এখানে থাকবে। কোনো বেতন নেই। সে ভাবে, তার মোবাইল ফোনটা বেচে দেবে। মা কিনে দিয়েছিল। মায়ের স্মৃতি…! তবু না বেচে তো উপায় নেই। সকালে স্টলে কাস্টমার এলে সে মোবাইল বিক্রির চেষ্টা করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

কয়লার খনি এলাকার চা-স্টল। ভোর থেকে শ্রমিকরা স্টলে আসতে শুরু করে। কয়লা শ্রমিকদের একজন অতুলকে দেখেই চিনে ফেলে। বলে, আরে! তোমাকে তো চেনা চেনা লাগতেছে। তুমি-তুমি, মনিন্দ্র স্যারের নাতি না?

হ্যাঁ, কিন্তু…

আমার বাড়ি ওখানে। তোমাদের পাশের গ্রামে কচু গড়ায়। তোমাকে আমি চিনি তো। তা তুমি এখানে কী করে এলে?

কয়লা খনিতে কাজ করতে এসেছিলাম।

তোমার তো কয়লা খনিতে কাজ করতে আসার কথা না। তুমি যে এখানে এসেছো, তা কি তোমার নানা-নানি জানে?

অতুল কথা বলে না। বরং মাথা নেড়ে জানায় যে, তারা জানে না। লোকটা বুঝতে পারে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। তাই তাকে ফের বলে, তুমি বাড়ি চলে যাও। কলেজে না পড়তে…। পড়ালেখা ফেলে এখানে আসা তো তোমার ঠিক হয় নাই।

তখন অতুল নিচু স্বরে বলে, আমি বাড়ি চলে যাব। কিন্তু, আমার কাছে কোনো টাকা-পয়সা নাই। আপনি আমার মোবাইল ফোনটা নেন, বেচে দেন! তাইলে আমি বাড়ি যেতে পারি।

শোন, তোমার নানা মনিন্দ্র স্যার আমার শিক্ষক। তোমার মোবাইল ফোন বেচতে হবে না। আমি টাকা দিচ্ছি। তুমি প্রস্তুতি নাও। আমিই তোমাকে বাসে তুলে দেব।

লোকটা সকাল আটটার বাসে তাকে তুলে দেবার সময় একজন পরিচিত শ্রমিক পায়। সে যাবে রংরা, ইন্ডিয়ার সীমান্তে। সেখান থেকে অতুলদের বাড়ি পাঁচ-ছয় কিলো দূরে। অতুলকে তার জিম্মায় দিয়ে বলে, কোনো চিন্তা করো না। তাদের বাড়ি ফুলবাড়ির উত্তরে পাহাড়ের ঢালুতে। তার নিচে পাদদেশেই তো ওপারের ফুলবাড়ি। তোমাকে সে একেবারে ফুলবাড়ি তোমার নানির আত্মীয়বাড়িতে দিয়ে আসবে।

পাহাড়ের ঢালু বুক কেটে তৈরি হয়েছে বাস-ট্রাক চলাচলের বিশাল রাস্তা। আঁকাবাকা পাহাড়ি পথে দুই ঘণ্টায় বাস থামে মেঘালয়ের রংরা সীমান্ত ফাঁড়ির কাছের বাসস্ট্যান্ডে। বাস থেকে নেমে লোকটা অতুলকে নিয়ে নিচে নামে। গনেশ্বরী নদীর পশ্চিম পাড়ে রংরা বাজার। বাজার এলাকা পার হয়ে ওরা নদীর চরের পথে হাঁটে কিছুটা পথ। এই চরের পথে মেঘালয় পাহাড়বাসীরা ইন্ডিয়ার সীমান্তঘেঁষা পথে যাতায়াত করে। শুকনো মৌসুমে পায়ে হেঁটে নদীর পশ্চিম পাড় থেকে পুবপাড়ে যায়। নদীতে হাঁটুর নিচে পানি। কাজেই নদী পারাপারে সমস্যা হয় না। বাজারে পাহাড়ি পণ্য বেচাকেনা শেষে নারী-পুরুষ গনেশ্বরী নদীর চরের পথে পূবদিকে চলাচল করে।

লোকটা অতুলকে নিয়ে নদীর পশ্চিম তীরে উঠে। রঘুনাথপুরে ১১৭২ নম্বর সীমান্ত পিলারের গাঁঘেষে বাংলাদেশ সীমান্তে পা রাখে। সীমান্তের এ পার-ওপারে একই নৃগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস বলে কে কোনদিকের অধিবাসী সীমান্তরক্ষীরা তা বঝুতে পারে না। তাদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে ততটা কড়াকড়িও নেই।

১১৭২ নম্বর পিলারটি নানা কারণে ঐতিহাসিক মর্যাদা পেয়েছে। একাত্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ২৬ জুলাই নাজিরপুরের সন্মুখ যুদ্ধে সাতজন মুক্তিযোদ্ধ শহীদ হন। এই পিলার সংলগ্ন স্থানে সাতজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে সমাহিত করা হয়। প্রতিবছর ২৬ জুলাই এখানে সাত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মরণে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। অতুল সমাধিস্থলে খানিকক্ষণ দাঁড়ায়। সমাধিস্থলের নামফলকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা পাঠ করে। তারপর ফের সাথের লোকটার সাথে হাঁটে। অতুল হাঁটে আর মনে মনে বলে, সমাধিস্থানটা বেশ সুন্দর এবং নিরিবিলি। তিনদিকে পাহাড়। দক্ষিণ দিকে সমতল। এ স্থানটির কাছে তাদের বাড়ি হলে বেশ হতো। মায়ের জন্য মন খারাপ হলে, এ সমাধিস্থলে একাকী বসে থাকতে পারতো। এমন সুন্দর নিরিবিলি পরিবেশে কিছুক্ষণ থাকলে মন ভালো হয়ে যেতো। 

তারপর সাত-আট মিনিট হেঁটে ফুলবাড়ি গ্রামে পৌঁছে। কলমাকান্দার উত্তর সীমান্তে লেঙ্গুরা ইউনিয়নের ফুলবাড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। তার সাথে সাতশহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি যোগ হয়ে স্থানটির সৌন্দর্য ও মহিমা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

ফুল বাড়িতে অতুলের নানির আত্মীয় বাড়ি। সেই বাড়িতে অতুলকে বুঝিয়ে দিয়ে লোকটা ফিরে যায়। কিছুক্ষণের মাঝেই মোবাইলফোনে যোগাযোগ করে নানিকে অতুলের খবর জানানো হয়। সাথে সাথে ওপাশে হইচই পড়ে। ওপাশ থেকে নানি আবার ফোন করে অতুলের সাথে কথা বলে।

অতুলের ক্ষীণ স্বর শুনে নানি বলে, কী রে অতুল! তোর গলার স্বর এমন চিকন শোনা যায় কেন, এখনো কি খাস নাই কিছুই?

দুই দিন যাবত ভাত খাই না নানি।

বলেই অতুল কেঁদে ফেলে। মা হারা নাতির এ কথা শুনে ওপাশ থেকে নানিও কাঁদতে থাকে। অতুলদের বাড়ি থেকে ফুলবাড়ি আর কতদূর। বড়জোর পাঁচ  কিলো। ততক্ষণে অতুলকে আত্মীয় বাড়িতে খাবার দেওয়া হয়। থালাভরা ভাত দেখে তার দুচোখ জলে ঝাপসা হয়। মনে মনে বলে, হায়রে ক্ষুধা…!

       ছেলেটা বেশ ক্ষুধার্ত – আঁচ করতে পেরে বাড়ির মহিলা আদর করে খেতে দেয়। মনের আনন্দে পেট পুরে খায় অতুল। এক ঘণ্টার মাঝেই নানা সাইকেল চালিয়ে অতুলকে নিতে আসে। নানা এখনো শক্ত-সামর্থ। আত্মীয় বাড়িতে খানিকক্ষণ বিশ্রামের পর অতুলকে নিয়ে রওয়ানা হয় নানা। সামনে বসিয়ে নানা চালায় সাইকেল। কিছুক্ষণের মাঝেই ফুলবাড়ি ছেড়ে লেঙ্গুরা বাজারের উত্তর পাশে গনেশ্বরীর নদী। ওরা হেঁটে পার হয় নদী। তারপর পাহাড়ের সমান্তরাল পূবদিকের সীমান্ত সড়ক পথে সাইকেল চালায় নানা। চলার পথে নানা জিজ্ঞেস করে, সত্যি করে বলতো অতুল! তুই আমাদের ছেড়ে ওপারে গেছিলি ক্যান?

জবাবে অতুল প্রথমে কিছু বলে না। দ্বিতীয়বার নানা বলে, কী রে! বলছিস না যে?

এবার ধীর গলায় অতুল বলে, মা মারা যাওয়ার পর পড়াশোনা করে আমি জানতে পারছি, সাংসারেক মতে কোনো মান্দি মারা গেলে তার আত্মা চিকমাং পাহাড়ে চলে যায়। পূনর্জন্মের আগ পর্যন্ত তো সেখানেই থাকে। খ্রিস্ট ধর্ম মতে তো অন্য রকম। আমার কাছে সেটা পর মনে হয়। গারোদের আদি ধর্ম-সংস্কৃতি বেশ আপন আপন লাগে। যেনো মায়ের মতো। আমি তো গারো মায়ের সন্তান। তাই…

এ কথা বলার পর কণ্ঠরুদ্ধ হয় তার। নানা তখন সাইকেল থামিয়ে নামে। নামে অতুলও। চেঙ্গিনী গ্রামে, ফসলি মাঠের মাঝ বরাবর সীমান্ত সড়ক পথে পশ্চিম থেকে পূবে যাচ্ছে ওরা। নানা বলে, থামলে ক্যান, বল না!

অতুল তখন নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়ে মাথা নিচু করে কান্নাভাঙা স্বরে বলে, আমি চিকমাং পাহাড়ে মায়ের কাছে যেতে চাইছিলাম! রাতে স্বপ্নে মা বলল, বাড়ি চলে যা, বাড়ির সবাই তোর চিন্তায় অস্থির।

নানার বুকেও তো সন্তান-হারা বাবার শোকের পাথর। অতুলের কথা শুনে নানার বুকে হিমালয় থেকে যেনো হিমবাহের ধস নামে। অন্তর্ভেদী শোকের ঘোরে পড়ে নানার মনে হয়, হিমবাহের ভয়াবহ  স্রোতে নেমে আসছে পাহাড় থেকে। মুহূর্তের মাঝে সেই বাঁধভাঙা স্রোতে আদিগন্ত ফসলি মাঠ, খাল-বিল, নদী-নালা, গ্রামের বাড়ি-ঘর সব তলিয়ে দিয়েছে। নানা-নাতিন কারো মুখে অনেকক্ষণ কোনো রা ফোটেনি।

#