গল্প =

ফেরা

রুহুল গনি জ্যোতি

অবশেষে শেখ ওমর সব কিছু ছেড়ে দিয়ে গ্রামে নিজের পৈত্রিক ভিটেতেই ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে মন স্থির করে ফেললেন। কিন্তু গ্রামে ফিরে যাব বললেই তো আর যাওয়া যায় না। তাছাড়া গ্রামে তো আর তার বাপ-দাদার জমিদারি নেই যে সেখানে গিয়ে উঠে পড়লেই হলো।

সেখানে কিভাবে দিন কাটবে? অর্থকড়ি কিভাবে আসবে? খাবার-দাবারেরই বা কি ব্যবস্থা হবে? রান্নাবান্নাই বা কে করবে-এসব নিয়ে তার দুশ্চিন্তা যেন আর শেষ হয় না।

ঢাকায় যে ভাড়া বাসায় এতকাল ধরে তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে ছিলেন সেখানকার আসবাবপত্রসহ সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে যে টাকা পেয়েছেন এবং তার কাছে নগদ যে টাকা ছিল তা দিয়ে সব ধার-দেনা শোধ করার পরও তার কাছে এখন যে অর্থ আছে তাতে গ্রামের বাড়িতে একটা সেমি পাকা ঘর করা যেতে পারে। যদিও পুরোপুরি বিল্ডিং করতে গেলে টাকায় কুলোবে না বলে তার ধারণা। তাছাড়া, শুধু ঘর করলেই তো আর হবে না সঙ্গে বিদ্যুতের লাইন, পানির ব্যবস্থা, বাথরুম আরো আনুষঙ্গিক কত কিছু করতে হবে।

আজকালকার গ্রাম আর আগের মত নেই। রাস্তাঘাটের উন্নতি, গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের প্রসার, মানুষের আয় রোজগার বৃদ্ধি, আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার আর নগর জীবনের প্রভাবে এখন গ্রামের মানুষজন যেন আরো জটিল হয়ে উঠেছে। গ্রামগুলো যেন অতি দ্রæতই বদলে যাচ্ছে।

চারদিকে মানুষের ভিড় কেবলই বেড়েই চলেছে। গ্রামে মানুষের নিজস্ব জগৎ বা ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু নেই। জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেখানে ভিলেজ পলিটিক্স, ষড়যন্ত্র, দলাদলি, গ্রæপিং আর এর বিরুদ্ধে ওর নানা ক‚টচাল নিয়েই যেন তাদের দিন কাটে।

গ্রামে এখন অধিকাংশ মানুষের চাষবাস প্রায় উঠেই গেছে। অন্তত তাদের গ্রামে এখন আর কারো চাষবাসই নেই। আগে গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরেই যেমন চাষবাস ছিল তেমনি তাদের ছিল গোয়াল ভরা গরু-ছাগল-ভেরা বকরি আর পুকুরে ছিল পর্যাপ্ত মাছ। এখন আর সেসববের বালাই নেই। অনেকেই শহরে গিয়ে চাকরি অথবা ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। অনেকেই চলে যাচ্ছে বিদেশে। সেখান থেকে অনেক কষ্ট করে তারা আয় করা টাকা পয়সা পাঠাচ্ছে আর বাড়িতে পরিবারের সবাই বেশ আয়েস করে সে অর্থ খরচ করছে।  

শেখ ওমর আজ বয়সের ভারে একেবারেই পর্যুদস্তু। সঞ্চয় যা ছিল তার অনেকটাই মেয়ে দুটোর বিয়ে দিতেই খরচ হয়ে গেছে। হয়তো তার বেঁচে থাকার মত যথেষ্ট অর্থই আছে। কারণ, তার বেসরকারি চাকরিতে সারা জীবন অনিশ্চয়তা থাকলেও আয় রোজগার একেবারে খারাপ ছিল না। তাছাড়া মাঝে মাঝে এটা সেটা টুকটাক ব্যবসা-বাণিজ্য করার ধান্দাও ছিল তার। ফলে, নানা ভাবে এখানে ওখানে ফাঁক ফোকরে কিছু কিছু টাকা পয়সা বিনিয়োগেরও ব্যবস্থা করেছেন তিনি। সেগুলো তেমন ফলপ্রসূ না হলেও এখনো বেঁচেবর্তে থাকার মত বেশ অর্থ করি তো তার আছেই বলা যায়।

কিন্তু তা থাকলে কি হবে-আসলে স্ত্রীর মৃত্যুর পর সংসারের কোন কিছুই তাকে আর সেভাবে তেমন টানছে না। জীবনটাই যেন অর্থহীন হয়ে পড়েছে। নিজেকে একেবারেই জড়পদার্থের মত মনে হচ্ছে আজকাল। কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। কোন কিছুর ব্যাপারেই তার আর কোন আগ্রহ নেই। বাসায় একদম একা বসে বসে সময় কাটান।

ধর্ম কর্ম আগেও তেমন একটা করতেন না। এখনও সেই একই অবস্থা। গান শুনতে বা টিভি দেখতেও ইচ্ছে করে না। বই, পত্র-পত্রিকা কোন কিছু পড়তেও আর ভাল লাগে না। ফলে, সারা দিন চুপচাপ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা ছাড়া তার যেন আর কোন কাজই নেই।

দুপুরের দিকে ছুটা কাজের বুয়া মরিয়ম আসে ঘন্টা খানেকের জন্যে, এর মধ্যেই ঝড়ের গতিতে সে সব কাজ করে দিয়ে চলে যায়। ভাতটাও বুয়াই রান্না করে দেয়। কখনো তিনি পাশের হোটেল থেকে তরকারি এনে খেয়ে নেন আবার কখনো নিজেই এটা সেটা ভর্তা-ভাজি করে খাওয়ার চেষ্টা করেন। কখনো কিছুই মুখে না দিয়েই বিছানায় অলস ভাবে পড়ে থাকেন। কখনো আবার বাইরে গিয়ে চা-নাস্তা কিছু একটা খেয়েই সারাদিন কাটিয়ে দেন।

জীবনে যে এমন অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে তা তো তার কল্পনাতের মধ্যেও ছিল না। এক সময় সারাক্ষণ ব্যস্ততা ছিল, হাতে ছিল শুধু কাজ আর কাজ। সকাল বেলা অফিসে গিয়ে একবার কাজের মধ্যে ডুবে গেলে সময় যে কোন দিক দিয়ে পার হয়ে যেত তা টেরও পেতেন না তিনি।

তবে সংসারের কাজ বলতে যা বোঝায় তা তিনি কখনো তেমন একটা করেননি। সংসার নিয়ে তাকে কখনো মাথাও ঘামাতে হয়নি। সারা জীবন গিন্নিই সব সামলেছেন। তিনি কখনো টেরই পাননি কিসে থেকে কি হচ্ছে। বাচ্চাদের পড়ালেখা, স্কুল, টিউটর কোন কিছুর খবরই তার কাছ পর্যন্ত আসতো না। মাসের প্রথম দিকে গিন্নির চাহিদা অনুযায়ী মাসিক খরচের টাকাটা তার হাতে দিয়েই খালাস। ভেবেছিলেন জীবনটা বুঝি এভাবেই কেটে যাবে। আসলে মানুষ যা ভাবে সবসময়ই কি আর তা হয়?

এই জীবনে তিনি কত মানুষের যে উপকার করেছেন, কত মানুষের আপদে বিপদে যে পাশে দাঁড়িয়েছেন তার যেমন ইয়ত্তা নেই তেমনি আবার নিজের সামান্য এই বসগিরির দাপটে কত মানুষের ওপর যে ঝাল মিটিয়েছেন তার কোন হিসেব শেখ ওমর নিজে কখনো রাখেন নি। ক্ষমতা আসলে মানুষকে দম্ভে অন্ধ আর অহঙ্কারী করে দেয়। ক্ষমতা হাতে পেয়ে সচেতন না থাকলে সেই ক্ষমতার দম্ভে কখন যে কার কি ক্ষতি করা হয়ে যায় বলা মুশকিল। পরে হাজার আফসোস করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া যায় না।

বেশ আনন্দময়ই ছিল সেইসব দিন। তখন কি ভুলেও কখনো তার মনে হয়েছে যে কোন একদিন তার গ্রামে ফিরে যেতে হতে পারে।

কিন্তু আজ তার আর এসব নিয়ে ভাবলে চলবে না। বর্তমানে অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে তাকে ফিরে যেতেই হবে। এই শহর আর তাকে ধারণ করতে পারছে না। তার চেয়ে বড় কথা হলো এই বয়সে এসে তার আর এই নগরীতে টিকে থাকার মত আর মনের জোরও নেই। কোথাও বেরুতেই ইচ্ছে করে না। এমন কি ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলে এনে  দৈনন্দিন খরচ চালাতেও ইচ্ছে করে না।

অর্থ রোজগার বা তা খরচ করার সব ইচ্ছেই যেন মরে গেছে তার। সব আশা, সব স্বপ্ন যেন একবারেই বিলিন হয়ে গেছে। ইদানিং বাড়িয়ালাকে ভাড়াটাও ঠিকমত দেন না। দিতেও ইচ্ছে করে না। এভাবে আর কয়দিন। পুরনো ভাড়াটে হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাড়িয়ালা হয়তো আপাতত কিছু বলছে না। কিন্তু এই ভাবে চলতে থাকলে ক’দিনই বা বাড়িয়ালা সেটা সহ্য করবে।

গ্রামে তবু পৈত্রিক ভিটেটুকু আছে। জমিজমাও যৎসামান্য যা আছে তাতে গিয়ে উঠে পড়তে পারলেই হলো। একা মানুষ, কোন মতে হয়তো দিনগুজরান করে বাকী জীবনটা পার করে দেয়া যাবে।

   তাছাড়া, গ্রামে তো আর পরিচিত-আপনজন তো কম নেই। তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করেও সময়গুলো হয়তো ভালই কাটবে।

অবশেষে একদিন ভোর বেলা বেলা ঘুম থেকে উঠে সব দুশ্চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে শেখ ওমর সত্যি সত্যি গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

মালপত্র লটবহর যা ছিল তার সবই প্রায় বেচে দিয়েছেন। এত জিনিসপত্রের বোঝা তিনি আর বইতে পারছিলেন না। এসব জিনিসপত্রের দামও তো একেবারে কম নয়। বিক্রি করে নগদ টাকা হাতে রেখেছেন যেন তা প্রয়োজনের সময় কাজে লাগাতে পারেন।

যদিও একবার ভেবেছিলেন আসবাবপত্রসহ সবকিছু সঙ্গে করে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু এসব নিয়ে যাওয়ার ঝক্কি-ঝামেলা তো আর কম নয়। তাছাড়া এত খরচ করে গ্রামে নিয়ে গেলেই তো হবে না কোথায় নিয়ে রাখবেন তারও তো ঠিক নেই। তিনি তো গ্রামে বসবাসের জন্য এর আগে কোন ব্যবস্থাই করেননি।

যদি নিজের ঘরবাড়ি থাকতো তাহলে এইসব ফ্রিজ-টিভি, চেয়ার-টেবিল, খাট-আলমারি, ড্রেসিং টেবিল একবারে সব নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবা যেত। একটা সংসারে জিনিস তো আর কম নয়। একদিন যা ঘরের শোভা বর্ধন করতো আজ  তা যেন বোঝা হয়ে তার উপরে চেপে বসেছে।

প্রতিটি জিনিসের সঙ্গেই রয়েছে কত সুখ-দুঃখের স্মৃতি। কত ত্যাগ আর কত কষ্ট করে ধীরে ধীরে এসব আসবাবপত্র সংগ্রহ করেছিলেন তার সহধর্মিনী আয়শা। সেই আয়শাই যখন আজ স্মৃতি হয়ে গেছে তখন আর এসব জিনিসের কথা মনে করেই বা কি লাভ? এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই ওমরের দিন যায়।

কিন্তু, তার পরও সেসব স্মৃতি আর মায়া কাটিয়ে অবশেষে এক একে সবই বিক্রি করে দিয়েছেন। অবশ্য মেয়েদের না জানিয়েই কাজটা সেরেছেন। কারণ, ওরা জানলে হয়তো বাধা দিতো এবং কিছুতেই তাকে গ্রামে ফিরে যাওয়ার এই সিদ্ধান্ত নিতে দিতো না বলে ওমরের ধারণা। এর ফলে, তার আর গ্রামে ফেরা হতো না। তাতে বরং পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠার আশঙ্কাই ছিল, ভাবতেন তিনি।

তাছাড়া, এত কিছু সঙ্গে করে গ্রামে নিয়ে গিয়ে তিনি কি করবেন। তাতে একদিকে যেমন আসবাবপত্রের বিশাল ভার তার ঘাড়ের ওপর চেপে বসবে-অপর দিকে শুধু শুধুই সবাই ভাববে, তিনি বিশাল বড়লোক। অথচ তার অবস্থা তো এখন আদৌ সেরকম নয়।

নিজের যা কিছু বহনযোগ্য সম্বল ছিল সেসব একটি ব্যাগে গুছিয়ে নিয়েই গ্রামের উদ্দেশে চললেন তিনি। বাড়িয়ালাকে আগেই ভাড়ার টাকা বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি ছাড়ার নোটিস দিয়েছেন। ভুলেও যেন তার মেয়েরা এই খবর জানতে না পারে সেজন্য বাড়িয়ালাকে সাবধান করে দিয়েছেন।

বাপ-দাদার পৈত্রিক ভিটে যেটুকু আছে, তা যে এখন কি আকার ধারণ করেছে, সেটি স্বচক্ষে না দেখলেও কল্পনায় তিনি যেন তা দেখতে পাচ্ছেন। তবু মন মানছে না। মনে হচ্ছে, গ্রামে গেলেই তিনি পরম শান্তি পাবেন। জীবনের বাকী দিনগুলো তিনি ওখানেই কাটিয়ে দেবেন। তার বিশ্বাস আর যে যাই করুক গ্রামের অকৃত্রিম প্রকৃতি তাকে আপন করে নেবেই।

যেভাবে জনসংখ্যা বেড়েছে তাতে গ্রামের বাড়িতে এতটুকু শূন্যস্থান বলে আর কিছু থাকার কথা নয়। এক সময়ে বাবার সংসারে তারা শুধু তিন ভাই আর দুবোন ছিলেন। এখন দুভাইয়ের ছেলেমেয়ে আর চাচাতো ভাইদের ছেলেমেয়েতে বাড়ি যেন গিজগিজ করে। বোনদের বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে বলে রক্ষে। নইলে, তারা সবাই যদি ছেলে-মেয়ে নিয়ে এখানে থাকতো তাহলে ব্যাপার যে কি রকম ভয়াবহ হয়ে উঠতো তা সহজেই অনুমান করা যায়।

গত ২০ বছরে তিনি একবারও গ্রামমুখো হননি। গ্রামে একটা পৈত্রিক ভিটা থাকলেও সেখানে যে বসবাসের মত করে ঘরবাড়ি করতে হবে সে কথাও তার কখনো মাথায়ই আসেনি। বড় ভাই অবশ্য আগে ঢাকায় এলেই এসব নিয়ে বলতেন। কিন্তু এ নিয়ে তিনি কখনো খুব একটা গা করেননি। ভেবেছেন মেয়েদের বিয়েসাদি হলেই তো তারা হাত-পা ঝারা। স্বামী-স্ত্রী দু’জনের কোন রকমে দিন কেটে যাবে। ওদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর ভেবেছেন এত এত বাড়িঘর করে লাভ কি? কে থাকবে? মেয়ে দুটোই তো দেশের বাইরে। ওদের স্বামীদের যা অবস্থা-ওরা তো দেশের বাইরেই বেশ ভাল চাকরি করছে। তারা আদৌ এদেশে এসে বসবাস করবে কিনা সন্দেহ।

দুটো মেয়েই পড়ালেখায় খুব ভাল ছিল। ফলে, ওরাও তো এখন আর বিদেশে গিয়ে বসে নেই। এদেশে এত ঝুট ঝামেলার মধ্যে আর কে আসে। মা তো মরেই গেছে, এখন বাবা মরে গেলেই দেশের সঙ্গে তাদের সব সূত্র একেবারেই ছিন্ন হয়ে যাবে, ভাবেন ওমর।

গ্রামে বাড়িঘর যা ছিল সব এখন দুভাইয়ের দখলে চলে গেছে। ঠিক দখলে বলাটা হয়তো ঠিক হবে না, ওরা তো গ্রামেই থাকে ওদের প্রয়োজনে সেসব জায়গা যার যার মত সব কাজে লাগিয়েছে। তাছাড়া, আগে তো পরিবার একটাই ছিল। এখন সবাই আলাদা আলাদা থাকছে, আলাদা আলাদা চিন্তা ভাবনা করছে। কিন্তু আজকালকার দিনে এক পরিবারের ঘরবাড়ি তো আর দুপরিবার মিলে ব্যবহার করতে পারে না, তা যতই পৈত্রিক হোক না কেন। তার উপর এখন আবার নানা রকম ক‚টচালের নাটক-সিরিয়াল দেখা গিন্নিরা তো অন্য পরিবারের লোকজনের সঙ্গে মানিয়ে চলাটাই ভুলে গেছেনÑহোক সে আপন ভাই। ফলে, দুই সহোদরের যা কিছু ব্যবহার্য জিনিসপত্র আছে সব কিছুই পৃথক। পৃথক আঙ্গিনা, পানির কল, বাথরুম, টিভি, ফ্রিজ সবকিছুই আলাদা।

একেবারে আহামরি বড়লোক না হলেও বর্তমানে গ্রামের প্রেক্ষাপটে ভাইদের আর্থিক অবস্থা মোটামুটি স্বচ্ছল বলা যায়। তবে, তাদের মনের স্বচ্ছলতার বড়ই অভাব। সারাক্ষণই তাদের মনে যেন এক ধরণের মানসিক অভাব লেগেই আছে। বিশেষ করে শেখ ওমরের গ্রামে ফেরার পর থেকে তা যেন একটু বেড়েই গেছে। ওমর সবই বুঝতে পারেন কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলেন না। এখন তার মাথায় একমাত্র চিন্তা যত দ্রæত সম্ভব বসবাসের উপযোগী একটা ঘর উঠানোর ব্যবস্থা করা।

এখন আসলে গ্রাম-শহর সবখানেই একই অবস্থা, এত মানুষ, চারদিকে কেবলই জনস্রোত-অথচ প্রয়োজনের সময় একটা কাজের লোক খুঁেজ পাওয়া যায় না।

ফলে, প্রথম থেকেই শেখ ওমর এসব ভেবে ধরেই নিয়েছেন গ্রামে সব কিছুই তার নিজের হাতেই করতে হবে হবে। কারণ, কাকে বা পাবেন একটু সাহায্য করার মত আর কোথায়ই বা খুঁজবেন?

গ্রামে ফেরার কথা তিনি আগেই তার আত্মীয়-স্বজনকে মুঠো ফোনে জানিয়েছিলেন, যাতে খুব কমসময়ের মধ্যেই তিনি সব কিছু গুছিয়ে নিজের মত করে সেখানে বসবাস শুরু করতে পারেন। কিন্তু, কেউই তার সেই কথা বিশ্বাস করেনি। সবাই হয়তো ভেবেছে আসবেন দু’চারদিনের জন্য বেড়াতে, কয়েক দিন হয়তো থাকবেন, তার পর চলে যাবেন। তার জন্য আর তাদের আলাদা করে প্রস্তুতির দরকার কি?

তিনি বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখলেন সেখানে কোন কিছুই আর আগের মত নেই। এত বছর পর প্রায় সব কিছুই যেন আমূল বদলে গেছে। তিনি যে একদিন এখানেই জন্মেছিলেন সেই কথাটিই যেন সবাই বেমালুম ভুলে গেছে। স্মৃতির কোন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। কেউই তার জন্য পথ চেয়ে বসে নেই। একজন অতিথির মতই বাড়ির সবাই তাকে গ্রহন করলো। তখন নিজেকে খুবই অসহায় মনে হলো। ভাবলেন এখানে আজ তার সব প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।

সবাই যার যার নিজেদের মত করে কাজে অকাজে ব্যস্ত, কেউ ঘরে বসে নেই। এখানে নিজেকে কেমন যেন একটা খাপছাড়া আর উটকো ঝামেলার মত মনে হলো, যেন আগন্তকের মত এখানে এসেছেন আবার কাজ সেরে হয়তো এখনই চলেও যাবেন। আজ তিনি এখানে বড্ড বেমানান। কেউ যেন তাকে আপন করে নিতে চাইছে না। সবচেয়ে আপন লোকেরাই তার গ্রামে ফেরা নিয়ে কেউ যেন তেমন খুশী হয়নি। এসব দেখে ওমর মনে মনে বেশ বড় এক ধাক্কা খেলেন। কিছুটা হতাশও হলেন তিনি।

ভাবলেন, শেষ পর্যন্ত এখানে তার বসবাস করা হবে তো। অথচ তিনি কত আস্থা আর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে গ্রামে ফিরে আসার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফিরে যাওয়ার কোন পথই আর তিনি রাখেননি বা রাখতেও চান নি। এখন তো কেবলই মনে হচ্ছে, এখানে যদি বসবাস করতে না পারেন।

আপাতত, ছোট ভাইয়ের একটা বৈঠকখানা ঘরেই তার অস্থায়ী ভাবে থাকবার ব্যবস্থা হলো।

এমনিতে গ্রামের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এখন ততটা খারাপ নয়। পাকা সড়কগুলো সারাক্ষণ ব্যস্ত। সেই ব্যস্ত রাস্তায় চলে সাইকেল, রিকসা, মোটর সাইকের, প্রাইভেট কার, ট্রাক এমন কি বাসও। ফলে, যখন তখন যানজট লেগে যায়।     আজকাল গ্রামে সবই আছে। তবে, সবই যেন নগরীর মিনি সংস্করণ। এছাড়া, রাস্তার মোড়ে মোড়ে যত্রতত্র রয়েছে চা দোকান। সেখানে দিনরাত সমানে চলে আড্ডা আর রাজনীতির আলোচনা। ক্যাবল টিভির কল্যাণে এসব দোকানে রয়েছে ডিস সংযোগ। সিনেমা আর বিভিন্ন চ্যানেলের খবর দেখে এবং সেগুলোর বিশ্লেষণ করে ব্যস্ত সময় কাটায় তারা। এসব আড্ডায় বসে গ্রামের লোকজন রাতদিন দেশ-জাতি উদ্ধার নিয়ে তুখোড় আলোচনা-সমালোচনায় মুখর হয়ে সমানে রাজা-উজির মারতে থাকে।

এসব চা দোকানে বসে বসে থাকা বেশির ভাগ মানুষেরই তেমন কোন কাজ নেই। স্ত্রী বা মা-বাবার হতেই তাদের সংসারের ভার। তাদের কাজ প্রধানত সারাক্ষণ দেশ বিদেশের খবর শোনা আর রাজনীতি নিয়ে তর্কবিতর্কে ডুবে থাকা আর নানান ধরণের মারপ্যাচ ও ক‚টচাল চেলে মানুষকে বিপদে ফেলা। গ্রামের মানুষগুলো যেন সহজ-সরল করে কোন কিছু ভাবতে পারে না।

দুপুরের পর থেকে এসব চা দোকানে শুরু হয় সিনেমা। কখনো বাংলা কখনো হিন্দি অথবা এক দোকানে বাংলা তো পাশের দোকানে হিন্দি ছবি চলতে থাকে। গ্রামের কাজকর্ম তো আর অফিস আদালতের মত নয়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বেশ অবসর মেলে। এ অবসরে বাড়ি থেকে একটু দূরে বসে চা খেতে খেতে আড্ডায় মেতে ওঠে অনেকেই।

গ্রামে বাড়ির গিন্নিদের বরং অনেক বেশি ব্যস্ততা নগর জীবনের পটের বিবি সেজে বসে থাকার সুযোগই নেই তাদের। সংসারের সব কাজই বলতে গেলে তাদেরই সামলাতে হয়। এসব ঘরকন্নার কাজে তারা বরং চায় স্বামীরা একটু দূরে দূরেই থাকুক।

আত্মীয়-স্বজন সবাই নানান কাজে ব্যস্ত। সবার নিজ নিজ ধান্ধা, ফলে সাহায্য করার মত কাজের লোকের খুব অভাব। বলতে গেলে গ্রামে কাজের লোক তেমন একটা পাওয়াই যায় না। খুব কষ্ট করে যাও বা দুএকজনের খোঁজ পাওয়া যায় তারাও আবার কাজে তেমন ভাল নয়। অথচ মজুরি এত বেশি হাকায় যে শুনলে পিলে চমকে যাওয়ার অবস্থা।                   

 আজকাল গ্রামের ছেলে-মেয়েরা একটু বড় হলেই বা একটু কিছু কাজ শিখলেই বাবা-মায়েরা তাদের গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করতে পাঠিয়ে দেয়। কেউই আসলে গ্রামে থাকতে চায় না। পেটের ধান্দায় সবাইকেই ছুটতে হয়। কেউ দেশে কেউ বা ছুটছে বিদেশে। কেবলই ছুটছে তারা। ফলে, গ্রামে কাজের লোকের বড়ই অভাব।

চাষবাসেরও বেহাল অবস্থা। যারা চাষবাসের কাজ করেন তাদের নিজেদেরই সব কাজ করতে হয়।

তবে, গ্রামের মানুষগুলো বদলে গেলেও প্রকৃতি যেন আগের মতই আছে। সেই ¯িœগ্ধ ছায়াঘেরা মায়াবি পরিবেশ। সবুজ সতেজ গাছপালায় ঘেরা বাড়িগুলো শেখ ওমরকে খুব টানে। সবই কেমন আপন মনে হয়। প্রকৃতি যেন তাকে এখনো আপন ভেবে মনে রেখেছে। গাছের ছায়ায় আর মাঠে প্রান্তরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেলেই তার মনটা ভাল হয়ে যায়।

শেখ ওমর গ্রামে ফিরেছেন ১৫ দিনও হয়নি, একদিন সকাল বেলা ঢাকা থেকে বাড়িওয়ালা ফোন করে জানালেন, প্রবাসী মেয়েদের কল্যাণে তার বাসা এখন নতুন সব অত্যাধুনিক আসবাবপত্রে সজ্জিত হয়ে তারই অপেক্ষায় রয়েছে। এবারে তিনি শুধু ফিরে গেলেই হয়। একথা শুনে প্রথমে তিনি এর আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। তারপর বাড়িওয়ালা যা বললেন, তা শুনে তো তিনি একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন।

একটু ধমকের সুরেই বাড়িয়ালাকে বললেন, আমি তো সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে চলে এসেছি আপনি টু-লেট টানিয়ে দেননি কেন? আর আমার মেয়েরাই বা এসব কেমন করে করলো?

বাড়িওয়ালা জানালেন, আপনি যাওয়ার দু’তিন দিন পর এসব ঘটনা ঘটেছে। আপনি তো মশাই গ্রামে গিয়ে ফোন বন্ধ করে করে বসে আছেন। ওরা বার বার কল দিয়েও আপনাকে না পেয়ে অবশেষে উদ্বিগ্ন হয়ে আমাকে ফোন করেছিল। আমি আপনার মেয়েদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখে সব ঘটনা খোলাখুলি বললাম।

ওরা আমাকে বললো, চাচা, আপনি চিন্তা করবেন না। বাবা এই বাসাতেই থাকবেন। আপনার কোন টু-লেট টাঙ্গানোর কোন দরকার নেই।

আসবাবপত্র সব বিক্রি করে দেয়া হয়েছে তো কি হয়েছে একজন মানুষ সারা জীবন ধরে কি একই আসবাবপত্র  ব্যবহার করে নাকি। মানুষের একটু চেঞ্জও তো দরকার হয়। আমরা এখান থেকে অনলাইনে অর্ডার করে আবার সবকিছু নতুন করে কিনে দিচ্ছি। আমরা নিজেরাই বাসা সাজিয়ে দেব, আপনি কোন চিন্তা করবেন না চাচা। বাবা নিশ্চিন্তে গ্রামের বাড়িতে ক’দিন বেড়াক ওনাকে এখনই কিছু বলার দরকার নেই।

পরে ওরা অনলাইনে বাসার জন্য প্রয়োজনীয় সব আসবাবপত্রই কিনেছে আর ওই দোকানের লোকগুলো এসে সব সেট করে বাসা পুরোপুরি সাজিয়ে দিয়ে গেছে। আপনার মেয়েরা সারাক্ষণ অনলাইনে থেকে সেগুলো দেখিয়ে দিয়েছে। ওরা যেভাবে যেভাবে বলেছে, সেভাবেই পুরো বাসা সাজানো হয়েছে। এবারে আপনি শুধু এসে দেখেন। আপনার কিন্তু ভালই লাগবে।

 এখন আর আপনার কোন সমস্যা নেই। কন্যারা জানিয়েছে, এখন থেকে বাসা ভাড়া নাকি ওরা সরাসরি আমাকে পাঠিয়ে দেবে। আপনার আর কিছুই ভাবতে হবে না। আর আপনি চাইলে রান্নার জন্য একটা বুয়াও আমি ঠিক করে রাখতে পারি। আপনার রান্নাবান্নার আর ঝামেলা থাকবে না। আপনি টাকা পয়সা নিয়ে ভাববেন না।

গ্রামে আসার পর থেকে শেখ ওমর একের পর এক এত বেশি ঝামেলার মধ্যে সময় পার করেছে যে বেশ কয়েকদিন তার ফোনটি আর অন করারই প্রয়োজন মনে করেননি। মনে মনে ভেবেছেন, কি হবে এত কথা বলে। তাছাড়া দুই মেয়ে ছাড়া তার তো আর খবর নেয়ার মত কেউ নেই।

মেয়েরাও আজকাল নিজেদের কাজ নিয়েই এত বেশি ব্যস্ত থাকে যে বাবাকে ফোন করার তেমন একটা সময়ই পায় না। এ নিয়ে তার মনে কিছুটা অভিমানও রয়েছে, কিন্তু তা থাকলেই বা কি। ওরা তো আর তার কাছে নেই। সুদূর প্রবাস থেকে তাকে দেখতেও পাচ্ছে না। তিনি ভেবে ছিলেন মেয়েরা হয়তো দু’একবার ফোন করে নিজেদের ব্যস্ততায় আবার সব ভুলে যাবে। কিন্তু এই ফাঁকে তার মেয়েরা যে এত কাÐ ঘটিয়ে ফেলবে তা তার কল্পনার মধ্যেও ছিল না। অথচ এখন তো ওরা একটা ঝামেলই বাঁধিয়ে ফেলেছে। বড় দ্বিধার মধ্যে পড়ে যান শেখ ওমর।

গ্রামে এসে আসলে কাজের লোকজনের অভাবে এখনো তিনি তেমন কোন কাজই শুরু করতে পারেননি। কবে যে শুরু করতে পারবেন তারও কোন ঠিক নেই। জায়গাটাও ঠিকমত বুঝে পাওয়া যাচ্ছে না। ভাইদেরও এই ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই। ক’দিন ধরে শুধু জায়গাটা পরিষ্কার করানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। কিন্তু সেটাও করতে পারছেন না।

রাজমিস্ত্রি-যোগালী সবাইকে খবর দেয়া হয়েছে কিন্তু কেউ আসেনি। বাড়ির কাজের জন্য তার ইঁট বালি সিমেন্ট কিনতে যাওয়ার কথা কিন্তু জায়গাটা এখনো ঠিক মত বুঝে না পাওয়ায় যাই করেও এখনো যাওয়া হয়নি। কাছেই বাজার কাজেই ইট-বালি-সিমেন্ট ক্রয় করা নিয়ে কোন সমস্যা নেই, বলা মাত্রই ওরা পৌঁছে দিয়ে যাবে।

ঠিক এই সময়ে মেয়েদের এতসব কান্ডের খবর পেয়ে শেখ ওমর একবারেই দোটানার মধ্যে পড়ে গেলেন। এখন আসলে কি করবেন। একদিকে গ্রামে তার নতুন জীবন শুরু করতে যাওয়ার প্রস্তুতি অন্য দিকে আবার নগরে ফিরে যাওয়ার আহŸান তিনি বসে বসে ভাবেন আর ঝিঁমুতে থাকেন।

রাতের দিকে বড় মেয়ে ফোন করে বেশ খুশী ভরা কণ্ঠে বললো বাবা, অনেক দিন পর তুমি একটা ভাল কাজ  করেছো। যেন বাসার স্মৃতি বিজরিত সব আসবাবপত্র বিক্রি করে দিয়ে সে বিশাল গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ করে ফেলেছে। মেয়ের প্রশংসা শুনে তিনি একটু অবাকই হলেন। মেয়ে বললো, ওসব পুরনো ফার্নিচার রেখে লাভ কি? এদেশে তো সবাই এধরণের আসবাবপত্র ফেলেই দেয়।

যাক, আমরা দুবোন মিলে পছন্দের সব ফার্নিচার দিয়ে তোমার বাসাটা সাজিয়ে দিয়েছি। এবার গিয়ে দেখো, হয়তো তোমার ভালই লাগবে, বাবা।

 গ্র্রামে বাড়ি করছি শুনেও মেয়ে খুবই উচ্ছ¡সিত হলো। কয়টা রুম, কয়টা বাথরুম, কি ফিটিংস দিচ্ছি? এসি লাগিয়েছি কিনা, গ্রামে এখন বিদ্যুতের অবস্থা কেমন? ইত্যাদি যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে করে যেন অস্থির করে তুললো।

গ্রামের বাড়ির ব্যাপারে কি যে আগ্রহ তার, যেন বাড়ির কাজটা শেষ হলেই সে আমেরিকা থেকে এখানে এসে বসবাস করতে শুরু করবে।

বললো, ভালোই হলো বাবা, আমরা এবার দেশে গেলে দুবোন মিলে সোজা গিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকবো আর সেখানে অনেক মজা করে ঘুরে বেড়াবো। আমাদেরও গ্রাম অনেক ভাল লাগে।

মেয়ের এত উচ্ছ¡াস আর আগ্রহের মধ্যে তার আর বলাই হয়ে উঠলো না যে তিনি স্থায়ীভাবেই গ্রামে চলে এসেছেন। আর কখনো তিনি ঢাকায় ফিরে যাবেন না ভেবেই তিনি স্থায়ীভাবে গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছেন। যদিও তিনি এখানে এসে এখনো কিছুই করে উঠতে পারছেন না। তিনি যেন এখানকার পরিবেশের সঙ্গেও আর কুলিয়ে উঠতেই পারছেন না।

মেয়ে তো আসলে বাড়িয়ালার কাছ থেকে সবই শুনেছে। কিন্তু সেও আর ওসব নিয়ে কিছুই বললো না। গ্রামের ব্যাপারে নানান কিছু জিজ্ঞেস করতে করতে বললো, বাবা, ভালই হলো, গ্রাম তো বেশ সুন্দর, ওখানে ঘরবাড়ি থাকলে কখনো ঢাকায় খারাপ লাগলে তুমি গ্রামে গিয়ে মাঝে মাঝে একটু বেড়াতে পারবে, কিছুদিন ওখানে থেকে মনটা ভাল করে নিয়ে আসতে পারবে।

মেয়ের কথা শুনে ওমর একদিকে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন, মনে হলো আরে তাই তো, মাঝে মাঝে গ্রামে আর মাঝে মাঝে ঢাকায়-এভাবে জীবনটা কাটাতে পারলে মন্দ কি?

অথচ তিনি এই সহজ বিষয়টি নিয়ে এতকাল কত যে দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন, নিজেকে এত অসহায় মনে হয়েছিল যে এ থেকে কিছুতেই এই বেরই হতে পরছিলেন না। কেবলই মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে তার প্রয়োজন যেন ফুরিয়ে গেছে।

গ্রামে বাড়ির কাজ শুরু করতে গিয়ে নানান প্রতিকুলতার মধ্যে পড়ে এবং গ্রামের মানুষের আচার আচরণ দেখে তার মনে যে হতাশা তৈরি হয়েছিল মেয়ের সঙ্গে আলাপের পর তা পুরোই কেটে গেল। ভাবলেন, সবই ধীরে ধীরেই হোক আর না হলে না হোক। এত বেশি ভবিষ্যতের কথা তিনি আর ভাববেন না। এত ভেবে লাভ কি? মরে গেলে যা হয় হবে।

আপাতত তার কাছে মনে হলো যেখানে তার ভাল লাগবে, সেখানেই তিনি থাকবেন। অন্তত যতদিন বেঁচে আছেন মনে কোন রকম টেনশন রাখবেন না। যে যাই বলুক, তার সঙ্গে যে যেমনই আচরণ করুক তিনি তার মত করেই এগিয়ে যাবেন। কাজ করে যাবেন মনের আনন্দে। সময় নিয়ে, অবস্থানের স্থান নিয়ে তিনি আর কিছুই ভাববেন না। বিশেষ করে জীবনে কোন কিছুই যখন চিরস্থায়ী নয় তখন আর কোথাও গিয়ে স্থায়ী হওয়ার চিন্তা করে লাভ কি।

হয়তো সহসাই একদিন তার স্থায়ী ঠিকানায় বসবাসের জন্যে ডাক আসবে। তখন সেই আহŸানে সাড়া দিয়ে সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে সেই অনন্তের পথে যাত্রা করতে হবে। সেটাই তো তার আসল গন্তব্য। তার জন্য এত আগে থেকে বসে বসে দিন গোনার চেয়ে বরং তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ জীবন সমুদ্রে প্রান্তবন্ত দেহ-মন নিয়ে অবিরাম সাঁতার কেটে যাওয়াই তো উত্তম। সেদিন অনেক রাত ধরে এসব কথা ভাবতে ভাবতে অবশেষে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন শেখ ওমর।

##